আমি যে এক আঁতেল প্রেমিক – ভালোবাসার গল্প
ভোর বেলা ফোনের মিষ্টি (!!!) আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ডিসপ্লে তে দেখি মাহিন এর বাবা ফোন দিচ্ছে। ফোন ধরে সালাম দিতেই আংকেল এর উৎকন্ঠিত আওয়াজ ভেসে এলো “বাবা, মাহিন কি তোমার বাসায়?” পাশে হাত ঘড়ি ছিলো। দেখলাম ভোর ৫.৪৫ বাজে। এই সময় মাহিন আমার বাসায় আসবে কোথা থেকে? আমি বললাম “না আংকেল। ও তো আমার বাসায় নাই” । আংকেল বললেন “বাবা কাল রাত থেকে মাহিন বাসায় আসে নাই”। আমি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠালাম। “আসেনি মানে? ফোন করেছেন?” আংকেল বলে “ওর ফোন বন্ধ”। আমি বললাম “আচ্ছা আংকেল আমি দেখছি”। আমি অনীতা কে ফোন দিলাম। আমার সাথে অনীতার রিলেশন হওয়ার পর পর ই অনীতার চাচাতো বোনের সাথে মাহিন এর রিলেশন হয়। বলা চলে আমরা দুইজন কল কাঠি নেড়ে করে দিয়েছি। অনীতা ফোন ধরে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল “হ্যালো, এতো সকালে?” আমি বললাম “হ্যালো হাই বায় বায় করার সময় নাই, তাড়াতাড়ি তোমার বোন কে ফোন দিয়ে শোন যে মাহিনের সাথে ঝগড়া টাইপের কিছু হইছে কিনা?” অনীতা বলে “কেন”। কইলাম “তোমার পেয়ারের দেবররে পাওয়া যাইতেছে না। রাত থেকে মশাই নিখোজ”। অনীতা আঁতকে উঠলো। বলল “আচ্ছা দেখছি”। প্রায় ৫ মিনিট পর ফোন দিয়ে বলল “না ওর সাথে মাহিনের কোন ঝগড়া হয়নি। মাহিন ওকে রাতে ফোন দেয়নি। তাই ও টেনশন এ আছে”। মেজাজ এর ৪৪০ হয়ে গেলো। গেলো কোথায় ইডিয়েট?
আমাকে এতো সকালে উঠতে দেখে আম্মু অনেক অবাক হলে।এসে চা দিয়ে গেলেন। আমি এর মধ্যে আমাদের আতেঁল গ্রুপের সবার সাথে কথা বললাম। কেউ কিছু জানে না। আমরা সবাই ঠিক করলাম বের হবো মাহিন কে খুজতে। কেবল বাসা থেকে বের হবো এমন সময় আংকেল ফোন দিয়ে বললেন “মাহিন বাসায় এসেছে। তোমারা কোন চিন্তা করো না। ও ঠিক আছে”। আমি অনীতা কে ফোন করে খবর টা দিলাম। প্রায় ১১ টার দিকে আমরা দল বল নিয়ে গেলাম মাহিনের বাসায়। দল বল মানে আমাদের আতেঁল গ্রুপ। গিয়ে দেখি মাহিন গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেছে। আমরা আংকেল কে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিলো। আংকেল দেখি রেগে টং হয়ে আচ্ছে। বল্ ল তোমাদের বন্ধুকেই জিজ্ঞেস করো। আমরা সবাই মাহিনের রুমে বসলাম। রুমে ঢুকেই দেখি কেমন একটা গুমোট গন্ধ। অথচ জানালা সব খোলা। আজব।
মাহিন গোসল থেকে বের হলে সবাই ওকে ছেকে ধরলাম। কি হয়েছিলো? কোথায় গিয়েছিলি ইত্যাদি। ও বলে “দোস্ত বাসায় বলা যাবে না। আব্বা শুনে খেপে আছে, বাহিরে গিয়া কইতাছি” মাহিনের বাসা থেকে বের হলাম। ও বলল “দোষ্ট আমি তো শেষ”। আমি ক্ষেপে গিয়ে বললাম “হতচ্ছাড়া, সারা রাত বাসার বাহিরে ছিলি, এখন বলিস তুই শেষ? মাইর খাস নাই তো। মাইর খাইয়া বড় লোক হয়ে যাবি”। ও বলে “দোষ্ট রাগ করিস না। আসলে আমার মন খুব খারাপ”। সবার একসাথে প্রশ্ন “কেন?”। তারপর মাহিন ওর ঘটনা বলল।
মোদ্দা কথা হল মাহিন আর তৃষার ঝগড়া হয়েছে। তাই মাহিন বিরহে সারা রাত বাহিরে কাটিয়েছে। তবে তার চেয়ে বড় যে সমস্যা আমি দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে আমার আর অনীতার প্রেমালাপে বাধাঁ পরতে যাচ্ছে। কারন অণীতা আমার সাথে দেখা করতে বের হয় তৃষা কে নিয়ে। একদিকে তৃষা আর মাহিন ডেটিং মারে অন্যদিকে আমি আর অনীতা। এখন মাহিনের সাথে ঝগড়া করে তৃষা তো রেগে আছে। তার মানে আমার সাথে অণীতার দেখা হওয়া বন্ধ। মাথার তার তো কেটে গেলো।
বাসায় ফিরে পিসির সামনে বসলাম। মাথার মধ্যে ব্যাপক চিন্তা চলছে। কতোদিনই বা আর তৃষা কে মাধ্যম হিসাবে দেখা করবো? এবার তো একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু কি করা যায়? অনীতাকে ফোন দিলাম। ওকে ব্যাপারটা বললাম। ও বলল এতো চিন্তা করার দরকার নাই। কিছু একটা উপায় বের হবে। আমি অনেক সকালে উঠেছিলাম। সাধারনত এতো সকাল এ উঠি না। তাই আবার দুপুরে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। এবং চোখ খুলেই আমি জেনে গেলাম আমাকে কি করতে হবে। পেয়ে গেছি আইডিয়া।
অনীতা কে ফোন দিয়ে বললাম তোমার বাবা এবং মা এর ডিটেইলস আমাকে ফেসবুকে মেইল করো। অবাক হয়ে বলল কেন? আমি বললাম পরে বলবো। এখন সময় নাই। কিছুক্ষন পর দেখলাম মেইল আসছে। আমি অল্পক্ষন পড়েই আমার টার্গেট পেয়ে গেলাম। এখন আমি জানি বরশির আগায় টোপ হিসাবে কি দিতে হবে।
পরের দিন সকালে। অনীতার বাবার অফিস। পেশায় উনি এখন বিল্ডার। বেশ নাম ডাক আছে। সবাই বলে উনি নাকি কথা দিয়ে মানুষ কে কিনতে এবং বেচতে পারে। এখন, আমি যাচ্ছি তাকে বেচতে। আসার সময় এলাকার এক বড় ভাই, উনি ডেসটিনি তে কাজ করেন। উনার কাছ থেকে কিভাবে মানুষ পটাতে হয় তার ছোট খাটো একটা ক্লাস নিয়েছি। এখন যাচ্ছি। আমি রিসিপশনে গিয়ে অনীতার বাবা মি.রফিকুল ইসলাম এর সাথে দেখা করতে চাইলাম। বলে এ্যাপয়েনমেন্ট আছে কিনা। আমার তো মাথা থেকে এটা বের হয়ে গিয়েছিলো। কি আর করার, ৪ ঘণ্টা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে থাকলাম। অবশেষ আমার ডাক পড়লো। অনেক আত্নবিশ্বাস নিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। দেখি চেয়ারের উপর একজন রাশভারী ব্যাক্তি বসে আছেন। চেহারা বলে দেয় ইনি বহু ঘাটের জল খাওয়া লোক। ইনাকে বেচে খাওয়া সহজ হবে না। রাশভারী কন্ঠে বলে উঠলেন “আপনার জন্য আমি কি করতে পারি? আপনি একটা ওয়েবসাইটের ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছেন”। আমি তাকে ঘণ্টা ধরে ওয়েবসাইটের মহাত্ন বুঝালাম। তার ব্যবসার কি কি উপকার হতে পারে, কি কি সুবিধা আছে। সাথে লাগিয়ে দিলাম যে উনার সব ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষেরই ওয়েবসাইট আছে। তিনি প্রথমে এমন ভাব নিলেন যে আমি মনে হয় তাকে নিম গাছের পাতার রস খেতে দিয়েছি। যখন প্রতিপক্ষের কথা তুলালাম তখন দেখলাম আগ্রহ দেখালেন। বেশ কিছুক্ষন বয়ান এবং ওয়েবসাইটের ফজিলত বর্ননা করে থামলাম। অবশেষে উনি জানালেন উনি সাইটে বানাবেন এবং সেই কাজের দ্বায়িত্ব আমাকেই দিলেন। উপরি হিসাবে আগাম আমাকে ১০ হাজার টাকাও দিলেন। আমি মনে মনে হাসলাম।
সাইটের কাজের জন্য ঘন ঘন তার সাথে অফিসে বসতে হলো আমাকে। কিন্তু কাজের চাপের জন্য তিনি অফিসে ঠিক মতো সময় দিতে পারছিলেন না। আমি জানতাম এমন টা হবে। তাই কৌশলে তার মাথায় বাসায় বসে কাজ করার আইডিয়া টা ঢুকিয়ে দিলাম। তিনি যাতে অফিসের পর অবসর সময়ে আমাকে নিজে বসতে পারেন সেই জন্য আমি তাকে কৌশলে জানালাম যে উনার বাসা যে এলাকায় আমি সেই এলাকাতে থাকি। উনি রাজী হয়ে গেলেন। বললেন সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৮ টা উনার বাসায় গিয়ে উনার সাথে বসতে হবে আমাকে। অফিস থেকে বের হয়ে উল্লাস এ লাফ দিলাম আমি। মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম।
প্রথম বারের মত অনীতাদের বাসায় যাচ্ছি। তবে যাচ্ছি তার বাবার কোম্পানীর সাইটের ডিজাইনার হিসাবে। অনীতাকে আগে থেকে বলে রেখেছিলাম প্লান কি। শুধু আমি যেভাবে বলেছি সে ভাবে করলেই কাজ হয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে নক করলাম। দেখি অনীতার মা দরজা খুলে দিলেন। আমি পরিচয় দিতেই ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। অনীতার বাবা তখন ও বাসায় ফেরেনি। আন্টি রান্না ঘরে ঢূকতেই অনীতা আমার কাছে ছুটে এলো। এসে বলে “অরীত্র তুমি পারো বটে। আমি তো ভেবেছিলাম আব্বুর কাছে ধরা খেয়ে যাবে। আমার বাবা অনেক বুদ্ধিমান”। আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম “আমার থেকে বেশি নয় জানেমান”। অনীতা হেসে বলল “হুম,মানলাম”। আমি ওকে বললাম “তুমি আপাতত যাও এখান থেকে। নাইলে পুরা প্লান নষ্ট হয়ে যাবে। যখন দরকার তখন ঠিক মতো হাজির হবা। তাহলেই হবে”। অনীতা কূর্নিশ করার মত করে মাথা হেলিয়ে “জো হুকুম মেরি আকা” বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমি মুগ্ধ চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর হাসিটা এতো পবিত্র আর সুন্দর যেন মনে হয় সারাদিন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসি আমি। এমন সময় চিন্তায় ছেদ পড়লো। আন্টি চা নাশতা নিয়ে ঘড়ে ঢুকলেন। এমন সময় অনীতার বাবা এলেন। এসে ফ্রেশ হয়ে আমাকে নিয়ে বসলেন। আমি তাকে কয়েকটা ডিজাইন এর ডেমো দেখাচ্ছিলাম।
ঠিক প্লান মত অনীতা এই সময় ঘড়ে ঢূকলো। এসে ওর বাবার পাশে বসে বলল “বাবা তোমরা কি করছো?” ওর বাবা বললেন “আমার কোম্পানীর ওয়েব সাইট টা ডিজাইন করছি মা” তখন অনীতা আমাকে চেনে না এমন একটা ভাব নিয়ে বলল “উনি কে?” ওর বাবা বললেন “আমাদের সাইটে ও ডিজাইন করছে। “আমি বললাম “হ্যালো,আমি অরীত্র”। অণীতা বলল “হাই,আমি অণীতা। আপনার নামটা সুন্দর”। আমি চমকে গেলাম। প্লানে এটাতো ছিলো না। ফাজিল মেয়ে। আমি বললাম “ধন্যবাদ”। তারপর ও বলল “আমি কি ডিজাইন গুলো দেখতে পারি? ”আমি বললাম “শিওর”। আমি ল্যাপটপটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। আগে থেকে শিখিয়ে দেওয়া অনুযায়ী ও প্রোগ্রামিং নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে লাগলো। বলছিলো কোন ডিজাইন এ কি সমস্যা। তবে আমি যেভাবে বলেছিলাম সেই সিরিয়াল মেইন্টেন করতে পারে নি। যেটাকে বলার কথা কালার লাইট করা দরকার সেখানে বলেছে সাইজ ঠিক নাই। আমাদের কথা শুনে ওর বাবা ওকে জিজ্ঞেস করলেন “মা তুমি এ সব বোঝ?” অনীতা বলল “বাবা নেট থেকে কিছুটা শিখেছি”। আমি তখন লাইনে এলাম “আপনি কিছুটা না,অনেক ভালো জানেন। আর একটু জানলেই আমার আর কাজটা পাওয়া লাগতো না”। ওর বাবা তো এসবের কিছুই বোঝে না। সাধারন সেন্স এ মানুষ যেটা করে যে নিজের ফ্যামিলি তে কেউ কোন নতুন বিষয় এ জানলে তাকে সেই বিষয়ের কাজ গুলা হ্যান্ডেল করতে দেয়। এখানে ব্যতিক্রম হলো না। ওর বাবা বলল “তাহলে তো ভালোই হলো। অনীতা তাহলে কাজ গুলো বুঝে নিতে পারবে। তোমাকে হেল্প করতে পারবে”। আমি বললাম “জ্বি”। মনে মনে বলছি এটাই তো চাই।
এরপর থেকে নিয়মিত ওদের বাসায় যেতে লাগলাম। কাজ হতো কিছুটা। ২ ঘণ্টার মধ্যে ২০ মিনিট কাজ করি আর বাকি সময় প্রেম করি।
১১ দিন পরের ঘটনা। সাইটের কাজ প্রায় শেষ। আমার মন আবার অস্থির হয়ে গেছে। কাজ শেষ হয়ে গেলে ওর সাথে দেখা করার উপায় থাকবে না। আবার লেট করলেও বেশি দিন করতে পারবো না। নইলে ওর বাবা সন্দেহ করতে পারে। এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি ওদের বাসার গেট এ এসে পৌছালাম। নক করলাম। কিন্তু কেউ খুললো না। গেট এ হ্যাজবোল্ট লাগানো। ভেতরে কেউ আছে কিনা,বোঝার কোন উপায় নেই। আমি অনেক বার নক করে কেউ গেট খুললো না। আমি ভাবলাম কেউ নাই। আমি চলে গেলাম। রাস্তা থেকে ওদের বসার দিকে তাকাতেই চোখে কিছু একটা অসংগতি ধরা পরলো। প্রথম বারে কিছু বুঝলাম না। তবে বুঝলাম কিছু একটা ঠিক নাই। ভালো করে তাকাতে বুঝতে পারলাম। রান্নাঘর। রান্নাঘরের কাঁচ গুলো ভাঙ্গা। ভেতরে থেকে বাষ্প বের হচ্ছে। মনের মধ্যে কোথাও সাইরেন বেজে উঠলো। কাল যখন এসেছিলাম তখন ও সব ঠিক ছিলো। আমি সিড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠতে লাগলাম। গেটের কাছে গিয়ে কান পাতলাম। হালক গোঙ্গানীর আওয়াজ পেলাম। মাথার আর কিছু কাজ করছিলো না, কোন এক অজানা আশংকায় মনে মেঘ জমলো। আমি কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে দরজায় লাথি মারলাম। তবে দরজা অনেক মজবুত। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছিলাম না। এদিকে শব্দ শুনে পাশের ফ্লাটের ওরা বের হয়ে এসেছে। আমাকে আগেও দেখেছে। আমি ব্যাখ্যা করলাম সবকিছু। ওই ফ্লাটের কর্তা এসে আমাকে সাহায্য করলেন। দুইজনে মিলে কয়েকবার ধাক্কা দেয়ার পর দরজা ভেঙ্গে গেলো। আমি দরজার সাথে ভেতরে পড়ে গেলাম। পড়িমড়ি করে উঠে রান্নাঘরে ছুটে গেলাম। যে দৃশ্য দেখালাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। মনে হলো আমার চারেদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আমার মন চিৎকার করে উঠছে না এ হতে পারে না।
মেঝেতে পরে আছে অনীতা,অজ্ঞান। সারা রান্না ঘরের মেঝে রক্তে একাকার। একটা ভাঙ্গা প্রেশার কুকার দেখতে পেলাম। অবশ্য বাকি কিছু দেখার সময় ছিলো না। পাশের ফ্লাটের উনাকে অনীতার বাবাকে কল দিতে বললাম। আমি অনীতাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিলাম। ছুটলাম সিড়ি দিয়ে নিচে। আতেঁল হলেও আমি মাঝে মধ্যে ফ্রী হ্যান্ড জিম করি। তার ওপর অনীতা খুব একটা ভারী না। আমি ওকে নিয়ে নামছি আর মনে মনে প্রার্থনা করছি “আল্লাহ প্লীজ অর যেন কিছু না হয়। আমি এই মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসি। ওর কিছু হলে আমি কি করবো জানি না”। সমস্ত অস্তীত্ব চিৎকার করে কিছু বলতে চাইলো। আমি নিচের গেট দিয়ে বের হলাম। পাশের ফ্লাটের আংকেল আগেই নেমেছেন। উনি দেখি উনার গাড়ি বের করে গেটের সামনে নিয়ে আসছেন। আমি অনীতাকে কোলে নিয়ে পেছনের সীটে বসলাম। আংকেল ছুটলেন হসপিটাল এর দিকে। অনীতার মাথা আমার কোলে। ওর রক্তে আমার সাদা শার্ট লাল হয়ে গেছে। ওকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি আমি। আংকেল এর গাড়ি চালানো দেখে মনে হলো উনি বোধহয় কার রেস করেন। আমি লাইফে কাউকে এতো ফাষ্ট গাড়ি চালাতে দেখি নাই।
হসপিটাল এর কেবিন। অনীতা বেড এ শুয়ে আছে। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। ওর মাথার পেছনে অনেক জোরে আঘাত লেগেছে। অনেক ব্লাড গেছে। সেটা সমস্যা না। ডাক্তার রা ভয় করছেন অপটিক্যাল নার্ভ এর ব্যাপার এ। ওটার ক্ষতি হলে অনীতা ওর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। আমি ওর বেডের পাশে বসে আছি। ওর একটা হাত আমার হাতে। ডাক্তার আমাকে বের হয়ে যেতে বলেছিলো। আমি এমন ভাবে ডাক্তার এর দিকে তাকিয়েছিলাম যে সে ভয়ে কিছু না বলে চলে গেছে। আমার মনে হয় তখন কেউ আমাকে অনীতার কাছ থেকে দূরে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে নির্ঘাত খুন করতাম আমি। অনীতার বাবা অফিস এর কাজে নারায়নগঞ্জ গেছেন। রওনা হয়েছেন। আরো ১ ঘন্টা সময় লাগবে আসতে। ওর মা গেছেন ওর নানাবাড়ি। রাজশাহী। ঊনার আসতে আরো ৪ ঘন্টা। আমি বাসায় ফোন দিয়েছিলাম। মিতি মানে আমার ছোট বোন আসছে। আমি অনীতার হাতটা ধরে চুপ চাপ বসে আছি। মনে মনে বলছি “ওর কিছু হবে না”। একটা কথাই বার বার বলে যাচ্ছি। একটু পর মিতি আর অভীক ঢুকলো। অভীক মিতির বয়ফ্রেন্ড। মিতি আমার কাছে এসে আমার কাধেঁ হাত দিতেই কেন জানিনা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। মিতিও কাঁদছে। ও আমাকে শান্তনা দিচ্ছে “ভাইয়া তুই কাদিস না, অনীতার কিছু হবে না। প্লিজ তুই কাদিস না ভাইয়া”। অথচ ও আমার চেয়ে বেশি কাঁদছে। অনীতা ওর বান্ধবী। মিতি অনেক প্যাঁচ খাটিয়ে আমার সাথে অনীতার রিলেশন করিয়ে দিয়েছিলো। আমি মিতি কে ছেড়ে অনীতার পাশে গিয়ে বসলাম আবার। অভীক মিতি কে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। আমার কেন যেন পুরো অস্তিত্ব ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছে।
দুই ঘন্টা পর।আমি ঠায় বসে আছি অনীতার পাশে। ওর বাবা এসে দেখে গেছেন। তখন ও আমি ওর হাত ধরে বসে আছি। ওর বাবা একবার আমার হাতের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। উনি বাহিরে ডাক্তার এর সাথে আলাপ করছেন। সব ডাক্তার এর জীবন খারাপ করে দিয়েছেন উনি। নিজের প্রভাব খাটিয়ে সব ডাক্তারকে হাজির করেছেন অনীতার জন্য। একটু পর পর ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছে ওকে। আমি ঠায় বসে আছি ওখানে। অভীক মিতিকে নিয়ে চলে গেছে বাসায়। ওরা সকালে আবার আসবে।
পাঁচ ঘন্টা পর। এখন রাত ১২ টা। আমি দুপুর এ কিছু খাই নি। সময় পাইনি। বাহির থেকে এসে গোসল করেই অনীতার বাসায় গিয়েছিলাম। রাতেও কিছু খাই নি। একটু আগে তৃষা এসেছে। ও বসে আছে কেবিনের অপর চেয়ারে। একটু পর তৃষা বলল “ভাইয়া আপনি গিয়ে খেয়ে আসেন। আমি আছি ওর পাশে”। আমি বললাম ঠিক আছে। যে কোন দরকার এ ফোন দিয়ো। কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি বাহিরের ওয়েটিং জোনে অনীতার বাবা বসে আছেন। আমাকে দেখে কিছু বললেন না। আমি লিফটের দিকে পা বাড়াতেই ডাকলেন “অরীত্র”। আমি ঘুরে দাড়ালাম। এগিয়ে এসে বললেন “তুমি কিছু খেয়েছ? ”আমি মাথা নাড়লাম।উনি বললেন “এসো আমার সাথে”। নিচে এসে একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢূকলাম। খাওয়ার রুচি নাই। শুধু খেতে হবে বলে খেলাম। মাঝখানে একটা কথাও হলো না। রেষ্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে উনি বললেন তুমি কেবিন এ যাও। আমি আসছি। শীতের রাত। কেবিনের ভেতরে কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না। বাহিরে এসে আমার কাঁপুনি ধরে গেছে। আমি তাড়াতারি কেবিন এ গেলাম। আবার অনীতার পাশে গিয়ে বসলাম। ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে। এখন ও ওর জ্ঞান ফেরেনি।
ভোর ৪ টা। এর মধ্যে ওর মা এসেছেন। ঊনিও আমাকে অনীতার হাত ধরে বসে থাকতে দেখে কিছু বললেন না। এসে মেয়ের কপাল এ হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর ছুটে বের হয়ে গেলেন। বাহির থেকে কান্নার আওয়াজ পেলাম।
ভোর ৫টা। চোখ ঘুমে ঢুলে আসছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সজাগ রেখেছি। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি। হটাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কি কারন এ ঘুম ভাঙ্গলো সেটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম, হটাৎ অনীতার হাত নড়তে দেখে বুঝতে পারলাম কেন ঘুম ভেঙ্গেছে। ওর হাত আমার হাতের মধ্যে ছিলো। হাত নড়ার কারনে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমি তারাহুরো করে উঠে বসলাম। ওর বেডের এক কোণায় মাথা দিয়ে দিয়ে ঘুমাইছিলাম আমি। ওর মুখের দিকে তাকালাম। অনিন্দ্যসুন্দর মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে আছে। কপাল এর কোনে আঘাত লেগে ফুলে আছে। ধিরে ধিরে চোখ খুললো ও। আমার মনে হলো দৃশ্যটা আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ট দৃশ্য। আমি অব্যাক্ত এক ব্যথা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। ও চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো। তারপর অস্ফুষ্টা স্বরে বলল “হাই জান”। আমি উত্তর দিতে গিয়ে আবিস্কার করলাম আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে। আমি ধরা গলায় বললাম “হাই”।
১৫ দিন পর। এর মধ্যে অনীতাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি প্রায় প্রতিদিন গিয়েছি ওর বাসায়। অবাক হলাম যে কেউ আমাকে কিছু বলল না। আমি সারাদিন ওর পাশে থাকতাম। আন্টি বরং দেখা যেত আমাকে আরো সাহায্য করতেন। দুপুরে ওদের ওখানে খেতাম। অনীতা ডান হাতে আঘাত পাওয়ার নিজের হাতে খেতে পারতো না। রাতে ওকে আন্টি খাইয়ে দিতো। দিনের বেলা আমি। আমি মজা করে বলি “ছোট বাচ্চা, খাইয়ে দিতে হয়”। ও তখন ঠোট ফুলিয়ে বলতো “ও আচ্ছা,ভালো লাগছেনা না?”। পরে দুইজনের হাসা হাসি করি। ঘাড়ে আঘাত পাওয়ার কারনে হাটা নিষেধ ছিলো কিছু দিন। তারপর আমি ওকে ধরে নিয়ে যেতাম বারান্দায়। আমার কাধেঁ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।
যাই হোক ওর বাসায় আজ যাওয়ার জন্য কারন ওর বাবা ডেকেছেন। আমি বাসায় ঢূকে দেখি ড্রইং রুমে পিতা মাতা দুইজন ই বসে আছেন। আমি সালাম দিলাম। বসতে বললেন। আমি বসলাম। অণীতার বাবা আমাকে বললেন “অরীত্র, আমি প্রথম দিন থেকে তোমার আর অনীতার ব্যাপারটা জানতাম”। আমি মনে হলো ৪৪০ ভোল্টের ইলেক্ট্রিক শক খেলাম। বোকার মতো উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
উনি হেসে বললেন “তোমারা কি ভাবো? আমাদের সময় আমরাও প্রেম করেছি। তোমার আন্টিকে আমি বাসা থেকে ভাগিয়ে এনে বিয়ে করেছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গেছি বিয়ের আগে। যুগ পাল্টেছে। কিন্তু প্রেমের রুপ তো পালটায় নাই। আমি প্রথম দিন তোমার আর আমার মেয়ের কাঁচা অভিনয় দেখে অনেক মজা পেয়েছি। পরে তোমার আন্টিকে সব বলেছি। আমরা আগে থেকেই সব জানি।“
আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। দেখলাম অনীতা ঘরের কোনে এসে দাড়িয়েছে। আমি আংকেল এর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আংকেল আমাকে বললেন “আমি প্রথম দিনই তোমার সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েছি। তোমার বোন যে আমার মেয়ের বান্ধবি সেটাও আমি জানি। কিন্তু তুমি যেটা জানোনা সেটা হলো তোমার বাবাও আমার বন্ধু ছিলেন। তোমার বাবার মৃত্যুর কিছু দিন আগেই আমি গিয়েছিলাম তোমাদের বাসায়। তুমি তখন অনেক ছোট।ভাবি আমাকে অনেক ভালো করে চেনে।“
আমি ভাবছি আমি কি আসলেই সত্যি শুনছি নাকি ভুল শুনছি? অনীতার দিকে তাকালাম। ও মাথা ঝাকালো। মানে সত্যি শুনছি। অনীতার মা এবার হাসি মুখে বললেন “ তোমার মায়ের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। উনাকে যা বলার আমরা বলেছি। উনি সম্মতি প্রদান করেছেন”।
আমি অস্ফুষ্ট স্বরে বললাম “কিসে সম্মতি?”
অনীতার বাবা বললেন “তোমাদের সম্পর্কে। আমরা দুই পরিবার একমত হয়েছি যে তোমরা পড়া শোনা শেষ করার পর তোমারদের সম্পর্কের শুভ পরিনতি হবে”।
আমার মনে হচ্ছিলো সোফা থেকে একটা লাফ দেই।কিন্তু পরে মনে হলো ঠিক হবে না। নিজেকে সংযত করলাম। অনীতার দিকে তাকালাম। ও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। না দেখেও বুঝলাম ও কাঁদছে। খূশির কান্না।
এবার ওর মা বললেন “তবে তোমাদের কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। প্রথম বিষয় পড়াশোনা শেষ করতে হবে। দুই সন্ধার পর তোমারা বাহিরে থাকতে পারবে না। অরীত্র আমাদের বাসায় দিনের বেলা আমার উপস্থিতিতে যখন খুশি আসতে পারো”।
আমি তো মনে মনে বলি দুইটা কেন হাজার টা শর্ত মানতে রাজি আছি। তবে মুখে তো আর বলা যায়না।
আমি বললাম “জ্বী”। আংকেল উঠে যাওয়ার আগে বললেন “টেক ইওর টাইম ইয়াং ম্যান। তোমরা পোলাপাইন এ সব বিষয়ে বাবা মাকে এতো ব্যাকডেটেড ভাবো কেন বুঝি না” বলে উনি এবং আন্টি চলে গেলেন।
আমি অনীতার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। দেখি তখনো ও কাদছে। আমি ওর চোখের পানি মুছে দিতে গেলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। হু হু করে কাদতে লাগলো। আমিও কাদছি। খুশির কান্না। হটাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল “বলেছিলাম না আমার বাবা অনেক বুদ্ধিমান। কি হলো তো এবার? ধরা খাইছো”
আমি বোকার মতো একটা হাসি দিয়ে বললাম “কি করবো বলো,আমি যে এক আঁতেল প্রেমিক”।
// অরিত্র আহমেদ – ভালোবাসার গল্প