এপসিলন অব লাভ – ভালোবাসার গল্প
বাসায় ফিরতে রাত করে ফেলেছে রোদ। বন্ধুর জন্মদিন এর পার্টি ছিলো। সকাল থেকেই সেখানে আছে রোদ। পার্টি শেষ করে বাসায় পৌছতে পৌছতে রাত ১১ টা। এসেই গোসলে ঢুকেছে। বের হয়ে এসে দেখে ফোনে ৬ টা মিসকল। অরিনের মিসকল। খেয়েছে রে ! মনে মনে ভাবছে রোদ। এখন ফোন দিলে গালা গালি করে ভূত ছাড়াবে।
সাত পাঁচ ভেবে শেষে কল দিয়েই ফেললো রোদ।
অরিনঃ শয়তান, এতোক্ষনে তোর ফোন করার সময় হলো?
রোদঃ আরে নাহ, গোসলে ছিলাম।
অরিনঃ সত্যি কথা বল, কোন মেয়ের সাথে টাংকি মারছিলি?
রোদঃ আজব, সবাই কি তোর মতো নাকি?
অরিনঃ কি? আমার মতো? তারমানে কি বোঝাতে চাস তুই? আমি ছেলেদের সাথে টাংকি মারি?
রোদঃ আরে নাহ, বললাম সবাই তোর মতো করে চিন্তা করে না।
অরিনঃ দেখ, কথা ঘুরাবি না। তোর খবর আছে। কাল ক্যাম্পাসে আয় খালি।
হা হা হা। এতো রোজকার ঘটনা। সারাদিন দুই বন্ধু একসাথে থাকে, মজা করে, এবং প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া করে। পরের দিন আবার একসাথে।
সকালে ক্যাম্পাসে পৌছানোর আগে রোদ দুইটা ক্যাটবারী চকলেট বার নিলো। অরিনের প্রিয়। দেখলেই রাগ ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখে অন্য ঘটনা। অরিন কেমন যেন চুপ চাপ হয়ে আছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে একদিনের ব্যবধানে বয়স কয়েক বছর বেড়ে গেছে। এ অরিন প্রানচঞ্চল অরিনের প্রতিচ্ছবি নয়, যেন জীবন যুদ্ধে হার মানা অরিনের অবয়ব। রোদ বারবার জিজ্ঞেস করার পরও কোন উত্তর পেলো না। এমনকি ক্যাটবারীও অরিনের মুখে হাসি ফোটাতে পারলো না। বন্ধু বান্ধব রা মিলে অনেক চেষ্টা করলো ওকে হাসানোর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
সেদিন ই ছিলো অরিনের সাথে সবার শেষ দেখা। এরপর হটাৎ করেই অরিনের ফোন বন্ধ, ক্যাম্পাসে আসে না। টানা তিন দিন এমন হওয়ার পর শেষে থাকতে না পেরে রোদ আর তুহিন গেলো অরিনের বাসায়। সেখানে আরেক কান্ড। বাসায় ইয়া বড় এক তালা। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে জানা গেলো তিন দিন আগে ওরা ব্যাগ বোচকা নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে। কিন্তু বাসায় আসবাব পত্র আছে। যাক, রোদ একটু রিলাক্স হলো এই ভেবে যে অরিনের গ্রামের বাড়িতে সাধারনত ফোন নেটওয়ার্ক একটু ঝামেলা করে, তাই কন্ট্যাক্ট করা যাচ্ছে না। পরে আবার রাগ ও হলো, কেন জানিয়ে গেলো না?
এরপর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। অরিনের দেখা নেই। প্রতি সপ্তাহেই রোদ নাহয় ওদের সার্কেল এর কেউ অরিনদের বাসা থেকে ঘুরে আসে। বাসা ওভাবেই আছে। কেয়ারটেকার কিংবা গার্ড কিছুই বলতে পারে না। তাদের বেতন ঠিকই আসে মাসে মাসে ব্যাঙ্কে। কিন্তু সাহেব কিংবা অরিন আপার কোন খবর তারা জানে না। শেষে তিন মাসের মাথায় থাকতে না পেরে রোদ, তুহিন আর প্রিয়ন্তি রওনা হলো ওদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠিকানা ভালো ভাবে জানে না। শুধু জানে সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ার কোথাও একটা গ্রামে ওদের বাড়ি। সারাদিন খোঁজার পর অবশেষে ওদের গ্রামের বাড়ির সন্ধান পায়। গ্রামের মানুষ সাধারনত অতিথি আসলে চরম ভাবে আপ্যায়ন করে। ওদের ও করলো। কিন্তু ওরা যখন বললো ওরা অরিনের বন্ধু, সবার আচরন যেন এক ধাক্কায় পালটে গেলো। কেউ সামনে আসছে না, ভালোভাবে কথা বলছে না, অনেক চেষ্টা করেও কোন কিছু জানা গেলো না। ওরা বাসা থেকে বের হয়ে আসছে তখন এক বৃদ্ধ মহিলা শুধু এতোটূকু বললো যে, অরিন নাকি বংশের মুখে কালি মাখিয়েছে। হটাৎ করেই রোদের মাথা গরম হয়ে গেলো। বৃদ্ধা না হয়ে অন্য কেউ হলে এতোক্ষন কি করতো বলা কঠিন। অরিন আর যাই হোক, উলটা পালটা কিছু করার মেয়ে না।
এরপর কেটে গেলো ৪ বছর। রোদ পড়াশুনা শেষ করে এখন চাকরী করে। মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। প্রতিদিন কোন না কোন মেয়ের ছবি এনে ঘন্টার পর ঘন্টা রোদের কাছে মেয়ের গুনগান গায়, বিয়ের জন্য চাপ দেয়। রোদের কথা হলো নিজেকে আরো একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর ও বিয়ের চিন্তা করবে। প্রিয়ন্তি, তুহিনের সাথে যোগাযোগ আছে এখনো। প্রিয়ন্তি বিয়ে করে এখন কানাডা প্রবাসি। স্বামী ব্যবসায়ী। তুহিন চিটাগাং এ আছে। কাষ্টমস এ ঢুকেছে। রোদ আছে একটা কর্পোরেট কোম্পানীতে। এক্সিকিউটিভ অফিসার। আজও মাঝে মাঝে মনে পড়ে অরিনের কথা। অরিনের দেয়া গিফট, বই গুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছে রোদ। আজও অরিন ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড। কাউকে সেই যায়গাটা দেয়নি রোদ। সযত্নে রেখে দিয়েছে, যদি অরিন কোনদিন ফিরে আসে? মিথ্যে আশা, তবুও তো আশা।
কিন্তু ভাগ্যের লিপিতে মনে হয় ভিন্ন কিছু ছিলো। হটাৎ একদিন রাতে তুহিন ফোন দিয়ে তোতলাতে শুরু করলো। তুহিনের পুরোনো স্বভাব, বেশি এক্সাইটেড হলে তোতলাতে শুরু করে।
রোদঃ আরে বেটা বলবিতো কি হয়েছে?
তুহিনঃ দোস্ত, ওককককে দেখেছি……..
রোদঃ কাকে?
তুহিনঃ আরেরররর ওকেকেকেকে….
রোদঃ তুহিন এইবার কিন্তু আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তুই আগে একটু দম নে, তারপর বল কে?
তুহিনঃ [কিছুক্ষন থেমে থাকার পর] অরিন।
রোদ ফোনটা এতো জোরে কানের সাথে চেপে ধরলো যেন ভেঙ্গে ফেলবে।
রোদঃ অরিন ! তুই কি ফান করছিস? দেখ, এই বিষয় নিয়ে ফান করিস না। প্লিজ।
তুহিনঃ ইডিয়েট। আমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি ফান করছি বেটা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা?
রোদঃ কোথায়? কিভাবে? কখন?
ঘটনা হলো, কিছুক্ষন আগে তুহিন গিয়েছিলো একটা রেষ্টুরেন্ট এ, খেতে। ফেরার পরে জ্যামে পড়ে। ও সি এন জি তে বসে হটাৎ খেয়াল করে পাশের রিকশা তে একটা মেয়ে, চেনা চেনা লাগে। গাড়ি গুলো একটু এগিয়ে রিকশা রোড লাইটের আলোয় আসতেই মেয়েটাকে চিনতে পারে তুহিন। অরিন ! সাথে সাথে নাম ধরে চেঁচিয়ে ওঠে। অরিন ওর নাম শুনে সি এন জির দিকে তাকিয়ে তুহিন কে চিনতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই রিকশা থেকে নেমে দৌড় দেয়। তুহিন ঘটনার আকষ্মিকতায় সি এন জি থেকে বের হতে হতে অরিন গায়েব।
রোদ এরপর শুধু একটা কথাই বলে।
রোদঃ তোর গেষ্টরুম খালি কর, আমি আসছি।
পরেরদিন অফিসে নিজের পাওনা ছুটির আবেদন করেই দৌড় দেয় রোদ। বাসে সময় লাগবে ভেবে রাতের ফ্লাইটে চিটাগাং। শাহ আমানত এয়ারপোর্টে ওকে তুহিন রিসিভ করে।
তুহিনের প্রথম প্রশ্নঃ প্ল্যান কি?
রোদঃ প্ল্যান?
তুহিনঃ বন্ধু এটা চট্টগ্রাম। ঢাকা শহর না হলেও, এখানে কাউকে খুঁজে বের করা যথেষ্ট কঠিন। প্ল্যানিং ছাড়া অরিন কে খুঁজতে বছর লেগে যাবে। আমার মনে হয়না তোর কোম্পানী তোকে এক বছর ছুটি দেবে।
রোদঃ হুম, তা অবশ্য ঠিক। একটু চিন্তা করতে দে।
এই ফাঁকে দুই বন্ধু রেষ্টুরেন্ট এ ডিনার সেরে ফেলে।
রোদঃ তুই তো কাষ্টমস অফিসার, তোর তো ডাটা ক্লিয়ারেন্স আছে তাইনা?
তুহিনঃ তা আছে, তবে বেসরকারী কোম্পানীর ক্ষেত্রে ওপর থেকে অর্ডার নিয়ে আসতে হবে। [ ডাটা ক্লিয়ারেন্সঃ কোন সরকারী কিংবা বেসরকারী প্রতিষ্টান থেকে কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্টান এর সম্পর্কে যে কোন সাধারন কিংবা গোপন তথ্য পাওয়ার অধিকার ]
রোদঃ হুম, সেক্ষেত্রে এক কাজ কর। অরিনের নামে একটা ফ্রড কেস ওয়ারেন্ট জোগাড় কর।
তুহিনঃ কি বলছিস ! মাথা ঠিক আছে? অরিনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট? কেন?
রোদঃ এটাই তো প্লান, তুই ওয়ারেন্ট জোগাড় কর কাল সকাল ১০ টার মধ্যে। কাজের ভার অন্য কাউকে দিয়ে রেডি থাকিস। ১০.৩০ এ মাঠে নামবো।
তুহিনঃ তোর কথা বার্তা কোনদিনও আমার আপার চেম্বার এ প্রবেশ করে নাই। আজও করলো না। যাই হোক, ওয়ারেন্ট পেয়ে যাবি।
সকালে ওয়ারেন্ট এর কপি রোদ এর হাতে দেয়ার পর রোদ ব্যাখ্যা করলো কিভাবে কাজ করবে।
রোদঃ শোন, চিটাগাং এ থাকতে গেলে অরিনকে অবশ্যই ব্যাংক এ অ্যাকাউন্ট রাখতে হবে, অন্তত এ টি এম কার্ডের জন্য। আর অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে অবশ্যই ন্যাশন্যাল আইডি কার্ড লাগবে। অথবা ও তো অবশ্যই সেল ফোন ব্যবহার করে, সেল ফোন এর সিমকার্ড কিনতে গেলে সেটা রেজিষ্ট্রেশন তো অবশ্যই করতে হবে। অবশ্য অনেকে আন-রেজিষ্টার্ড সিমকার্ড ব্যবহার করে। যদি সেখানেও পাওয়া না যায়, তাহলে ওকে জীবিকার জন্য কিছুতো করতে হয়। চাকরী অথবা কোন ধরনের কাজ। সেখানে তো ওর রেকর্ড থাকবে। অথবা পাসপোর্ট। আজকাল যে কোন সেন্সেবল মানুষ সুযোগ পেলেই পাসপোর্ট করিয়ে নিচ্ছে। পাসপোর্ট অফিসেও রেকর্ড থাকতে পারে। ইন্টারনেট মডেম, সিটি কর্পোরেশন, ভোটার তালিকা কোথাও না কোথাও তো নাজিয়া আফরিন অরিনের রেকর্ড থাকবে, তাইনা? কিন্তু আমি বা তুই গেলে তো দেবে না প্রাইভেসী পলিসির কারনে। সেই জন্য এই ওয়ারেন্ট। কাষ্টমস এর ফ্রড কেস ওয়ারেন্ট দেখালে এই সব কোম্পানী কিন্তু অধিদপ্তর গুলো তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। যদি পাওয়া যায় তাহলে ফলস এলার্ম বলে ওয়ারেন্ট টা বাতিল করে দিবি, হিসাব খতম ।
তুহিন কিছুক্ষন স্থবির হয়ে থাকলো। তারপর,
তুহিনঃ রোদ, বন্ধু আমার, তুই একটা জিনিয়াস। এখন বল এতো জায়গায় যদি আমরা যাই, তাহলে কয়েকদিন লেগে যাবে। লোকাল পুলিসের সাহায্য নেবো?
রোদঃ না, পুলিশ কে জড়ানো ঠিক হবেনা। তুই বরং তোদের অফিসের সাহায্য নে। দেখ অফিসে কে কে বসে আছে, তাদের ওয়ারেন্ট হাতে যেসব যায়গার কথা বললাম সেগুলোতে পাঠা, আমরা একটা যায়গায় বসে অপারেট করবো। ওদের বলবি এটা ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রায়োরিটী লেভেল ৪। তাহলেই হবে।
তুহিনঃ তুই ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রায়োরিটি লেভেল সম্পর্কে কিভাবে জানিস?
রোদঃ তুই ভূলে গেলি? আমার মামা প্রতিরক্ষা সচিবালয়ে আছে?
তুহিনঃ হা হা, আসলেই ভূলে গিয়েছিলাম। ওকে, আমি কাজ শুরু করলাম। আমার অফিসে বসে অপারেট করবো। চল।
টানা ৩৬ ঘন্টা পর তিনজন নাজিয়া আফরিন অরিনের খোঁজ পাওয়া গেলো। একজন স্কুলের শিক্ষিকা, একজন এক ব্যাংকার এর স্ত্রী, শেষের জন এক হসপিটাল এর অ্যাকাউন্টেন্ট। এরপর বিকেল থেকে প্রত্যেকটা যায়গায় খোঁজা শুরু করলো রোদ আর তুহিন। প্রথমে গেলো ব্যাংকার এর বাসায়। বিশাল দেহী এক স্থুলকায় মহিলাকে দেখে ওরা বাসার ভেতরে না ঢুকেই পালালো। আর যাই হোক এই মহিলা অরিন না। হসপিটাল এ গেলো, সেখানেও যাকে পেলো সে ওদের অরিন না। স্কুলে যাওয়ার সময় দুই জনের বুক দুরু দুরু করছে। অরিন, ৪ বছর পর দেখা হবে, সেই হাসি খুশি অরিন। কি হয়েছিলো ওর?
স্কুল অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। দাড়োয়ান এর কাছ থেকে অরিনের বাসার ঠিকানা পাওয়া গেলো। গেটে নক করেই দুইজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো। গেট টা খুলো গেল আস্তে করে। দুজনেই তাকে আছে গেটে দাঁড়ানো একটা চেহারার দিকে। সেই পুরোনো চেহারা। শুধু চোখের নিচে কালি জমেছে। আগের সেই উজ্জ্বলতা নেই আর, জিন্স আর কামিজ পরা অরিন কে শাড়িতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। অরিন ওদের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রোদ ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছে অরিনের দিকে। তুহিন মাথা নিচু করে আছে। জানা কথা কাঁদছে। প্রায় পাঁচ মিনিট এভাবে যাওয়ার পর অরিন বললো ” ভেতরে আয়”।
আধা ঘন্টা পর। অরিনের বাসার ছাদে। অনেক সময় নিয়ে ওরা শুনলো অরিনের জীবনে কি হয়েছিলো। তুহিন বের হয়ে গেলো কিছু খাবার কিনে আনতে। আজ ওরা বন্ধুরা সবাই মিলে অনেক দিন পর ডিনার করবে। ছাদে রোদ আর অরিন বসে আছে।
অরিনঃ বিয়ে করেছিস?
রোদঃ নাহ, মা খুব তোরজোড় করছে। আমি এড়িয়ে যাচ্ছি।
অরিনঃ কেন? কারো প্রেমে পরেছিস নাকি?
রোদঃ আরে নাহ, ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করছি। জীবনে একবার ই কারো প্রেমে পড়েছিলাম।
অরিনঃ বলিস কি? এই চার বছরে নাকি?
রোদঃ নাহ, সেই ভার্সিটি জীবনে।
অরিনঃ কে তানিয়া নাকি?
রোদঃ আরে ধূর। তানিয়া? পাগল হয়ে গেলি নাকি?
অরিনঃ তো কে? বলনা প্লিজ দোস্ত।
রোদঃ বাদ দে না। পরে শুনিস। এখন বল, তোর জীবন কেমন চলছে?
অরিনঃ এই তো কোন রকমে কেটে যাচ্ছে রে।
রোদঃ ঢাকা ভার্সিটির ইকোনমিক্স এর টিচার দের প্রিয় ছাত্রী, স্যারের যাকে বলতেন ডিপার্টমেন্ট এর ভবিষৎ চেয়ারম্যান, সে আজকে এমন একটা জীবন লীড করছে। ভালো।
অরিনঃ ভাগ্য বড়ো কঠিন জিনিস রে দোস্ত। যাকে দেয়, তাকে দিয়েই যায়। যাকে দেয়না, সে কখনো সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনা।
রোদঃ তোর বয়স কতো রে?
অরিনঃ এমন একটা ভাব নিলি মনে হচ্ছে জানিস না?
রোদঃ তাও, বল।
অরিনঃ ২৭ বছর কয়েক মাস। কেন?
রোদঃ ২৭ বছরেই তোর জীবন শেষ? বাকিটা টা কি?
অরিনঃ তুই কি দেখতে পাচ্ছিস না? বুঝতে পারছিস না? আমার কি আর কিছু করার মতো অবস্থা আছে?
রোদঃ ঢাকার বাসাটা বিক্রি করেছিস কবে?
অরিনঃ বাবার চিকিৎসার জন্য বছর দুয়েক আগে। বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। মাও ধিরে ধিরে সেই কষ্টে চলে গেলেন এক বছর পর। গত এক বছর ধরে আমি একা। নিজের একলা জীবন নিজের মতো করে কাটাচ্ছি।
রোদঃ হুম দেখতে পাচ্ছি। কাল সকালে তুই আমার সাথে ঢাকা যাচ্ছিস।
অরিনঃ তা হয় না রোদ। জীবনের অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। আমি সেই অরিন নেই রে। কেন শুধু শুধু আমাকে নিজের বোঝা বাড়াবি? কেন কষ্ট করবি?
রোদঃ তাইনা? যে অরিনের সাথে আমার একদিন ঝগড়া না করলে ামার ভাত হজম হতো না, সেই অরিন আজ আমার বোঝা? যে অরিনের জন্য আমি আমার কষ্টের দিন গুলোতেও হেসেছি সেই অরিন আমার জন্য কষ্ট? শোন, অনেক হয়েছে তোর ড্রামা। আমি বলেছি তুই যাবি মানে যাবি। দ্যাটস ফাইনাল।
অরিনঃ রোদ, এনাফ। ইমোশনাল হয়ে জীবন চলে না। প্লিজ জোর করিস না। বন্ধুত্বের যেটুকু এখনো বেঁচে আছে, সেটা নষ্ট করিস না।
রোদঃ তাই? শুধুই বন্ধুত্ব? আরে ইডিয়েট, কলেজ লাইভ থেকে এই ১০ বছরেও কি এটা বুঝিস নাই যে আমি শুধু একজনকেই ভালো বাসতে পেরেছি? কাকে ভালো বাসতাম জানিস? আমি তোকে ভালোবাসতাম রে পাগলি। আজো বাসি। কেন কখনো বুঝিস নাই তোর মুখের হাসি আমার কাছে এতো জরূরী ছিল কেন? কেন বুঝিস না তোকে খুঁজে বের করার জণ্য আমি সব কিছু ছেড়ে কেন চলে এলাম? নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছিস? কখনো ভেবেছিস? কলেজ লাইফ থেকে ফাঁকিবাজ আমি নিয়মিত ক্লাসে যেতাম তোর মুখ দেখার জন্য ইউ ইডিয়েট। তোর হাসি শোনার জণ্য গম্ভীর আমি নিয়মিত জোক মারতাম। কেন ভাবিস নাই? কেন খেয়াল করিস নাই তোকে ছাড়া কাউকে কখনো আমি কিছু দিয়েছি কিনা? কেন তোর অ্যাটেনশন আমার জন্য এতো জরুরী ছিলো? আমি তোকে ভালোবাসি, অরিন। এরপরও কি বলবি এনাফ, জোর করিস না and all that bullshit?
অরিন আর কিছু বলতে পারলো না। অদম্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
গভীর রাত। বাসে করে ঢাকা ফিরছে রোদ আর অরিন। তুহিন ছুটি ম্যানেজ করেই দিন দুয়েকের মাঝে চলে আসবে। অরিন সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবছে রোদ, কি হয়েছিলো অরিনের। ৫ বছর আগে এক দূর্ঘটনায় অরিনের বাবাকে রক্ত দিয়ে হয়েছিলো। স্ক্রিনিং বিহীন সেই রক্তে ছিলো এইচ আই ভি। সাথে সাথে দেখা না দিলেও প্রায় ৭ মাসের মাথায় ধরা পড়ে এইচ আই ভি এর লক্ষন। এবং সাথে সাথে শুরু হয় আমাদের সমাজের মাতব্বর টাইপের কিছু মানুষের অত্যাচার। অরিনের বাবাকে একজন খারাপ মানুষ, চরিত্র হীন মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের এলাকায় থাকতে দেবে না, এই ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ওরা গ্রামের বাড়িতে যায়, কিন্তু গুজব যে বাতাসের আগে ছড়ায় সেটা ওরা ভূলে গিয়েছিলো। সেখানেও গ্রামের মানুষের ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়ে ওরা। সেই সাথে সবাই অরিনের নামেও নানা বদনাম দেওয়া শুরু করে। তিলকে তাল করে রিতিমতো জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। অরিন ওর বাবা মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসে। বন্ধুদের জানানোর সাহস হয়নি, পাছে তারা ভূল বোঝে এই কারনে। বাবা একসময় চলে যান, মা ও চলে যান। একা অরিন সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। নিজের জন্য বেছে নেয় এক কষ্টের জীবন, যেখানে অন্তত তাকে কেউ অপয়া বলে কটুক্তি করবে না।
অরিন কে ঘুমিয়ে যেতে দেখে রোদ ফোন বের করে মাকে ফোন দিলো
“মা আমি বিয়ে করবো। মেয়েকে তুমি চেনো। বাকিটা বাসায় এসে বলবো। তুমি বাবাকে বলো সব কিছু রেডি করতে”।
অরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রোদের হটাৎ ওর লেখা একটা কবিটা মনে পড়ে গেলো। —
তোমার জন্য সপ্ন, তোমার জন্য ভালোবাসা,
তোমার জন্য কুয়াশার মাঝে নীল ধোঁয়াশা,
অক্ষিকোটরে কিসের যেন মায়া, বেদনা, স্থুল কষ্ট,
ভোরের শিশিরের স্পর্শ, একটু একটু করে নষ্ট
হটাৎ গর্জে ওঠে গগন, তীব্র আলোর ঝলকানী,
ভালোবাসা ছিন্ন করে এগিয়ে যাবার হাতছানি,
কিছু পথ, কিছু কাল, উপরে অবনীল, নিচে মহাকাল
তবুও প্রানহীন দেহে কিসের যেন মায়া, সুপ্ত কায়া।
কেঁদে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর মাঝে কিসের যেন বার্তা,
তবে কি দানবের অভ্যুথান, তবে কি প্রেমের আর্তনাদ?
কামজ নগরের সপ্ন বিক্রিকারীরা,ক্ষীন তনু,বিচিত্র ললাট
তবুও কেন যেন তাদের মাঝে এক সপ্ন বিক্রি করার হাট
হটাৎ করেই ঝুম ঝুম বৃষ্টি, ঈশান কোনে কালো মেঘ
দূরের ঝাপসা প্রান্তরে তোমার অবয়ব, হাতছানি
পাগল প্রেমিক ছুটে যায়, দু হাত বাড়িয়ে খোঁজে তোমায়
হটাৎ তুমি দূর থেকে হারিয়ে যাও, শুধু ভেঙ্গে পড়ে কান্নায়
জানালার পাশে শোকে পাথর একটা জামা, একটা গ্লাস
জানালা দিয়ে পথিক দেখে এক হতাশ প্রেমিকের শেষ নিঃশ্বাস
হটাৎ করেই তোমার আগমন, কেন চলে যাচ্ছো আমায় ছেড়ে,
আমি যে অংকুর, থাকবো পাশে, উঠবো তোমার ছায়ায় বেড়ে
সিক্ত ভালোবাসা, স্বতঃস্ফূর্ত জীবন, দূর থেকে এক আশীর্বাদ
ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসে, কখনো কাছে, কখনো আশেপাশে
শুভকামনা, প্রেমিক-প্রেমিকা,নতুন জীবন দৃশ্যমান, ভোর হচ্ছে
সূর্য পানে তাকিয়ে তুমি, আমার হাত ধরে, ভালোবাসি, ভালোবাসি
// অরিত্র আহমেদ – ভালোবাসার গল্প