ঈশানের গল্প – ভালোবাসার গল্প
ঈশান আমাদের বন্ধু দের মধ্যে সবচেয়ে প্রানচঞ্চল ছিলো। চব্বিশ ঘন্টা কিছু না কিছু করে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। ঈশানের দুইটা বদভ্যাস ছিলো। একটা হলো ও প্রচুর পরিমানে চা খেতে পারত। একবার বসলে দুই তিন কাপ চা খাওয়া কোন ব্যাপার ছিলো না ওর কাছে। আরেকটা হলো ও অনেক কথা বলতো। সরাসরি বললে বাচাল। কিন্তু ছেলেটার মন খুব ভালো ছিলো। খুব দ্রুত মানুষকে আপন করে নিতে পারত।
ঈশান অনেক আগে থেকেই একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। কিন্তু এতো বাচাল হলেও মেয়েটাকে কোনদিনও বলতে পারেনি যে সে তাকে ভালোবাসে। আমরা ওকে অনেক টিটকারী মারতাম এ নিয়ে। মেয়েটার নাম ছিলো শ্রাবন্তী। ঈশান অনেক বেশি ফর্সা ছিলো। আমাদের আড্ডায় শ্রাবন্তির টপিক আসলেই ঈশানের চেহারা লাল হয়ে যেতো, ফর্সা বলে ভালো ভাবে বোঝা যেতো।
মধ্যবিত্ত পরিবার এর সন্তান ঈশান। বাবা-মার খুব ইচ্ছা ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াবে। ঈশানের ইচ্ছে ফিল্মমেকিং নিয়ে পড়াশোনা করবে। ওর স্মৃতি শক্তি ছিলো অসাধারন, তবে শুধু ফিল্মের ব্যাপারে। ৭০ এর দশক থেকে হালের এমন কোন নায়ক নায়িকা, ডাইরেক্টর থেকে অন্যান্য মুভি রিলেটেড ব্যাক্তিত্ব ছিলোনা যার বায়োডাটা ঈশান জানতো না। আড্ডা দিতে বসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেতো আড্ডা শেষ হচ্ছে কোন আর্টি মুভির ওপর ঈশানের লেকচার দিয়ে।
ঈশানের খুব ইচ্ছে ছিলো ৫২ ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা মুভি বানাবে। যতোবার শহীদ মিনারের আশে পাশে গিয়েছি, ও অবলীলায় বর্ননা করে যেতো কোথায় কি ধরনের সিন ও বসাবে। মাঝে মাঝে শুনতে ভাল লাগতো। মাঝে মাঝে আমরা বিরক্ত হতাম।
২০১০ এর মার্চে একবার আমরা সবাই মিলে প্লান করলাম ঈশান আর শ্রাবন্তীর মিল করিয়ে দেবো। সব কিছু ঠিক ঠাক, ঈশান একটা পার্কে শ্রাবন্তীকে প্রপোজ করবে, আমরা আশেপাশে থাকব। শ্রাবন্তীকেও ওর এক বান্ধবীকে দিয়ে ডাকিয়ে আনা হবে। সব ঠিক। নির্দিষ্ট দিনে শ্রাবন্তীও এলো। আমরা অপেক্ষা করছি ঈশানের জন্য। বিকেলে প্রপোজ করার কথা। সন্ধার দিকে শ্রাবন্তী চলে গেলো, যাওয়ার আগে অনেক ঊল্টা পালটা কথা শুনিয়ে গেলো আমাদের। আমরা চুপ চাপ শুনলাম, ঈশানের ওপর সবার মেজাজ খারাপ। ঈশানের দেখা মিললো তিন দিন পর। আমরা যে যার মতো ওকে কথা শুনালাম। বকা ঝকা করলাম। জোবায়ের রেগে মেগে ওকে কাপুরুষ ও বললো। ঈশান একটা কথারও জবাব দিলো না। সেদিন আড্ডা হলো না। এরপর থেকে আড্ডায় দেখা যেতো ঈশান বেশিরভাগ সময় অনুপস্থিত। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম আমাদের কথায় রাগ করেছে, তাই কম আসে। একসময় একেবারেই আসা বন্ধ করে দিলো। একদিন সবাই মিলে ওর বাসায় গেলাম। ভাবলাম ওর রাগ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে বের হবো। বাসায় গিয়ে শুনি ঈশান নেই। কোথায় যেন গেছে। আমরা অবাক, আমরা ছাড়া তো ও কারো সাথে আড্ডা দেয় না। পর পর তিন দিন ওর বাসায় গেলাম। একদিনও ওকে পেলাম না। শেষে একদিন দেখা পেলাম সায়েন্স ল্যাব এর সামনে, গাড়ি ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু চিন্তা না করেই ওকে ঝাড়ি দিলাম যে বেশি ভাব দেখায় কেন, কোথায় থাকে সারাদিন? বন্ধুদের মধ্যে ক্যাচাল হতেই পারে, সেটা নিয়ে তো এতো কাহিনী করার দরকার নাই। ঈশান চুপচাপ শুনে গেলো। একটা কথারও জবাব না দিয়ে চলে গেলো। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
তিন মাস পর একবার একটা কাজে ফরিদপুর গেলাম। সেখানে হটাৎ এমন একটা যায়গায় দেখলাম ঈশান কে, দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। জায়গাটা ফরিদপুরের বিখ্যাত পতিতালয়। ঈশান এখানে কি করছে ভেবে মেজাজ এবং মন দুইটাই খারাপ হয়ে গেলো। ভাবলাম ঢাকা ফিরে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করবো। সেই সুযোগ হয়নি। পাঁচ দিন পর রোড অ্যাক্সিডেন্ট এ মারা এছে ঈশান। ওকে মাটি দিয়ে ওর বাসায় গেলাম। আংকেল আন্টির সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি। ওর রুমে ঢুকলাম। ওর একটা ডায়েরী দেখলাম টেবিলের ওপর। ডায়েরী টা পড়তে গিয়ে মাথা আরো চক্কর দিয়ে উঠলো। শেষে যা জানতে পারলাম, তাতে নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে কাঁদি। বলি, বন্ধু যেখানেই আছিস মাফ করে দিস।
ঈশান এর এক আত্নীয়র মেয়ে ওদের বাসা থেকেই মানূষ হয়েছিলো। ঈশান এর চেয়ে দুই বছর এর বড়। ঈশানের বাবাই তাকে এক বিদেশে বসবাস রত বাংলাদেশী ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। ছেলেটা মেয়েটাকে কোন ধরনের চোরা উপায়ে সেখানে নিয়ে যায়। এরপর মেয়েটা সেখানে গিয়ে দেখে ছেলেটা ওখানেও একটা বিয়ে করেছে। বাবা-মার চাপে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। ছেলেটার বউ এর নির্যাতন এ মেয়েটার খুব খারাপ অবস্থা হয়। এক হিউম্যান ট্রাফিকিং এর সাথে জড়িত ব্যাক্তির মাধ্যমে সে দেশে ফিরে। কিন্তু সেই ব্যাক্তি তাকে পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করে। মেয়েটা লজ্জায় তার পরিবার এর কাছেও যেতে পারছিলো না। মেয়েটা ঈশানের চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড় হলেও, ঈশান কে নিজের ভাইয়ের মতো দেখতে। ঈশান এর ক্ষেত্রেও তাই। ঈশান কিভাবে যেন খোঁজ পায় মেয়েটা ফরিদপুরের একটা পতিতালয়ে আছে। মেয়েটাকে সেখান থেকে বের করার জণ্য আপ্রান চেষ্টা করে ঈশান। কিন্তু পতিতালয় যারা চালায় তারা মেয়েটাকে কোন ভাবেই ছাড়বে না। তারা টাকা দাবী করে। ঈশান এর যেদিন শ্রাবন্তীকে প্রপোজ করার কথা, সে দিন ঈশান নিজের একটা কিডনী বিক্রি করে কিছু টাকা জোগার করে। দূর্বল শরীর নিয়েই ও নানা ভাবে টাকা ম্যানেজ করা শুরু করে। পার্ট-টাইম জব, টিউশন ইত্যাদি। আমি যেদিন ওকে ফরিদপুরে দেখেছিলাম, সেদিন ও মেয়েটাকে আনতে গিয়েছিলো। ওখানে থাকার ফলে মেয়েটা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাকে একটা মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি করে ঈশানের বাবা-মা। এতো সব কিছু করে যখন ঈশান বিজয়ের হাসি হাসছে তখন একটা দূর্ঘটনায় ও আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আমরা ভাবতেও পারিনি আমাদের বাচাল ঈশান এতো বড় একটা কথা নিজের ভেতরে চেপে রেখেছে।
এখানেই হয়তো ঈশানের গল্প শেষ হতে পারতো, হয়নি। আমরা সবাই তখন ঈশানের রুমে। এমন সময় সেখানে কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবন্তী আসে। আমরা এমনিতেই মানসিক ভাবে বিপর্যন্ত। কেউ ভাবতেও পারিনি এখানে শ্রাবন্তী আসবে। জোবায়ের এর মাথা বড়া বড়ই গরম। ও শ্রাবন্তীকে চরম অপমান করে। যখন ঈশান বেঁচে ছিলো, তখন ও তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো, তখন কোথায় ছিলে তুমি? আজকে এসেছে নাটক করতে? শ্রাবন্তী চুপ চাপ শুনে গিয়েছিলো। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে গিয়েছিলো, আমি একটা মেয়ে, আমি কি আগে বলবো আমি তাকে ভালোবাসি?
// সম্পূর্ন সত্য ঘটনা, নাম এবং স্থান গুলো পরিবর্তিত//
// এই ঘটনা টা এক বড় ভাইয়ের মুখে শোনা। ঈশান উনার বন্ধু ছিলো//
// মূল ঘটনাকে অপরিবর্তীত রেখে কিছুটা ভাষাগত পরিবর্তন করা হয়েছে //
// অরিত্র আহমেদ – ভালোবাসার গল্প