যৌন শিক্ষা, কতোটা জরুরী এবং আমরা কতোটা জানি?
লেখার শুরুতেই বলে দেওয়া দরকার, এই লেখাটা যৌন শিক্ষা নিয়ে। বাংলাদেশে অনেকেরই যৌন শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ আছে, সমস্যা আছে। আমি যতটা সম্ভব শালীনতা বজায় রেখে লেখার চেষ্টা করবো। তবে যদি কেউ চান, এই ওয়ার্নিংটা পড়েই বন্ধ করে দিতে পারেন।
আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রিয় ডট কম এর একটা লেখা চোখে পড়লো। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন সুড়সুড়ি বিষয়ক বই বিতরণ! লেখাটা পড়েই মেজাজ খানিকটা খারাপ হলো। পুরো লেখা শুধু বই থেকে কোট করা। সাংবাদিকের যদি মনে হয়ে থাকে এই বইটা যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে ভর্তি, তাহলে সেটার ব্যাখ্যা তার দেওয়া উচিৎ ছিল। এই ধরনের একটা শিরোনাম দিয়ে বাকি লেখা শুধু বই থেকে কোট করে কি ধরনের সাংবাদিক দ্বায়িত্ব পালন করা হয়েছে সেটা আমার মাথায় ঢুকলো না।
আমি আমার নিজের ব্লগ ঢুকেছিলাম অন্য একটা লেখা লিখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হল এই বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার। বলা উচিৎ।
যারা আমার লেখা পড়ছেন, তাদের মধ্যে কয়জন বলতে পারবেন তারা সুস্থ যৌন শিক্ষা পেয়েছেন? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি সংখ্যাটা শতকরা ৫ জনের বেশী না। আমি নিজেও যৌনতা বিষয়ে যা জানি, তার কোনটাই সুস্থ ভাবে আসেনি।
অসুস্থ যৌন শিক্ষা কি? খোলাখুলি কথা বলি। আপনি সেক্স বা যৌন মিলন সম্পর্কে কি জানেন? কিভাবে জানেন? ৯০% ই উত্তর দেবে তারা স্রেফ জানে। অবশ্যই তারা অলৌকিক কোন উপায়ে তো জানে নাই। নিশ্চয়ই কেউ তাদের বলেছে, কিংবা তারা কোথাও পড়েছে। কিংবা দেখেছে। এই শোনা, পড়া বা দেখার কোনটাই প্রাতিষ্টানিক ভাবে আসেনাই।
একটা ছেলে বা মেয়ে যখন বয়ঃসন্ধির মধ্যে দিয়ে যায়, তার শরীরে অনেক ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। পরিবর্তন যেগুলো সে আগে কখনো দেখেনি। তার লম্বা হওয়ার গতি বেড়ে যায়। মেয়েদের মাসিক শুরু হয়, তাদের স্তন এর আকার বৃদ্ধি শুরু হয়। ছেলেদের দাড়ি, মোচ বের হয়। উভয়েরই পিউবিক হেয়ার বা গুপ্ত কেশ গজানো শুরু হয়। তবে শারীরিক পরিবর্তন যতটা না হয়, তারচেয়ে বেশী চাপ যায় মনের ওপর দিয়ে।
ছেলেদের গলার স্বর চেঞ্জ হয়ে যায়। তারা কথা বলতে অনেকটা সংকোচ বোধ করে। হুট করে দাঁড়ি মোচ গজানোর কারণে মানুষের সামনে আসতে তাদের লজ্জা লাগে। আমি মেয়েদের ব্যাপারটা খুব একটা বলতে পারবো না, তবে যতোটুকু বুঝতে পারি তাদের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ হয়। মাসিক শুরু হওয়ার ব্যাপারটা কোন মেয়েই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না। অনেকেই প্রথম প্রথম প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই শরীর থেকে এতো রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে, যে কেউই ভয় পাবে। অনেকেই বাসায় ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না। দিনের পর দিন তারা প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করে, কষ্ট করে। অনেক সময় না পেরে বাসায় বলে। কিংবা মায়েরা বুঝে ফেলেন।
এই পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক আছে। সমস্যা হলে, বুঝে ফেলার পরে কি ঘটে? ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা বা বড় ভাই একটা রেজার ধরায়ে দেয়, কিংবা টাকা দেয় কিনে নেওয়ার জন্য। মেয়েদের ক্ষেত্রে মায়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ধরিয়ে দেয়, কিভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দেয়। ঐখানেই শেষ, ফুল স্টপ।
ছেলেদের কেন দাড়ি মোচ গজাচ্ছে, কেন গলার স্বর পাল্টাচ্ছে এগুলো কখনওই ব্যাখ্যা করা হয়না। মেয়েদের ঋতুস্রাব কেন হচ্ছে বা এই রক্ত কোথা থেকে আসছে, বা তলপেটে কেন এতো ব্যাথ্যা হচ্ছে, এগুলো কখনো পরিষ্কার করা হয়না। এগুলো স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া, এগুলোর মধ্যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ নেই, এগুলো ছেলেদের পাশে দাঁড়িয়ে বা মেয়েদের হাত ধরে কেউ কখনো বলে না। বলে না কারণ বাবা-মা বলতে লজ্জা পান, কিংবা নিজেরা ঠিকভাবে জানেন না। কিন্তু সন্তানকে এগুলো সম্পর্কে না বলে ঠিক কি ধরনের বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন, সেটার কোন ধারনা নেই তাদের।
এবার বলি বাংলাদেশে ছেলেরা / মেয়েরা কিভাবে যৌন শিক্ষা লাভ করে। মেয়েদের এ ব্যাপারে মায়েরা কিছুটা আইডিয়া দেন। কিন্তু তাদের পুরো আইডিয়াটাই থাকে এইটা খারাপ, এইটা একটা নিষিদ্ধ জিনিস, তোমার স্বামীই সাথেই শুরু জায়েজ। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে স্থাপনের রিস্ক কি, কিংবা তার খারাপ সাইড গুলো কোথায়, সেগুলো কখনওই ব্যাখ্যা করা হয়না। ছেলেদের ক্ষেত্রে ফ্যামেলীর কাছ থেকে কোন ধরনের শিক্ষা আসে না। তারা ভেবেই নেই ছেলে হাওয়া থেকে সব জ্ঞান লাভ করে নেবে।
এরপর পুরো জিনিসটা বিস্তার লাভ করে হাইস্কুলে। স্কুলে দেখা যায় ক্লাসের কেউ একটা রগরগে চটি বই নিয়ে আসে ক্লাসে। এরপর পালা করে সবাই সেটা নিয়ে বাসায় বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে কিংবা বাথরুমে বসে পড়ে। তারা পরে গোপন প্রেমের কথা, বিকৃত যৌনতার গল্প। তাদের জ্ঞানের শুরুটাই হয় ভুল একটা দর্শন নিয়ে। এরপর যখন মোবাইল ফোন হাতে আসে, তখন একে অপরকে পর্ন ভিডিও শেয়ার করে। বাসা এসে সেগুলো দেখে। সেখান থেকে আরও কিছু ভুল ধারনার জন্ম হয়। তারা যেটা জানে না সেটা হল পর্ন এবং রিয়েলিটির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। পর্ন এ যারা অভিনয় করে, তারা অভিনেতা। তারা অভিনয় করে। বাস্তবে তার কিছুই ঘটে না।
এর মধ্যে আর বিপদজনক এক ধরনের পর্ন আছে। বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই গোপনে রেকর্ড করা পর্ন ভিডিওর একটা বিশাল জনপ্রিয়তা আছে। অনেক গুলো আছে যেগুলো গোপন, অনেক আছে যেখানে মেয়েটা হয়তো না বুঝেই ভিডিও করতে রাজি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাঁচাতে ছেলের চাপে রাজি হয়েছে। এরকম অনেক ঘটনা আছে। আর এই ধরনের পর্ন সবচেয়ে বেশি বিপদজনক।
অনেকেই এই ধরনের পর্ন দেখে নিজেরা ভিডিও করতে উদ্যোগী হয়। অনেকে ক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই অন্য কেউ এই ভিডিও গুলো লিক করে দেয়। এরপর যেসব ঝামেলা হবে সেগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম।
এই এতোগুলো সমস্যা, এর শুরু কোথায়? শুরুটা শৈশবে, বয়ঃসন্ধিতে। তখন যদি তারা জানতো যে যৌনতা কি, তাদের শারীরিক পরিবর্তন কেন হচ্ছে, তাহলে অনেক কিছুই এভয়েড করা যেতো। এই দ্বায়িত্ব টা বাবা-মার। যদিও আমাদের দেশের বাবা – মা তো পারলে মাটিতে মিশে যাবে এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে। পারলে তো বাচ্চাকে ৬ মাস বয়সেই বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়িয়ে দেয়। ২ বছর পর্যন্ত যে খাওয়ানোটা জরুরী, এইটা তারা মানতেই চান না। পাপ হবে বলে বাচ্চাকে বঞ্চিত করেন অনেক পুষ্টি গুন থেকে।
এখন অ্যাকাডেমিক ভাবে যৌন শিক্ষার বিস্তার করা এই দেশে একটু ঝামেলার। আমার মনে আছে একবার নওগাঁ জেলা স্কুলে থাকতে আমাদের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সিদ্ধান্ত নিলেন উনি AIDS এর ওপরে সব ক্লাসে আলোচনা করবেন। উনার বয়স তখন ৩২-৩৫ এর মতো হবে। উনি আমাদের ক্লাসে এসে বোর্ডে AIDS লিখে কি বলবেন সেটা চিন্তা করতে গিয়েই হিমশিম খেয়ে গেলেন। অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে গেলেন, কিন্তু সামাজিক প্রতিবন্ধকতা যে কতোটা প্রবল, উনি নিজে সেটা সম্ভবত সেদিন অনুভব করেছিলেন। কথার মাঝে মাঝেই উনি থেমে যাচ্ছিলেন, ভাবছিলেন পরের শব্দ বা লাইনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত হবে কিনা।
গ্রামের কোন স্কুলে যদি এসব নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়া হয়, তাহলে গ্রামের লোকজন হয়তো শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। একবার একটা গ্রামে দেখেছিলাম একজন স্বাস্থ্য কর্মী কয়েকজন মেয়েকে ব্যাখ্যা করছিলেন ঋতুস্রাব কি এবং কি কি করতে হবে। গ্রামের মহিলারা উনাকে গালি দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিলেন, উনি নাকি গ্রামের মেয়েদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছেন খারাপ খারাপ কথা বলে।
এরকম একটা পর্যায়ে যদি সুস্থ যৌন শিক্ষা দিতে হয়, সেটা দিতে হবে স্কুল লেভেল এ। কিন্তু ক্লাসে বসে যেহেতু দেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা এই জাতীর আসেনাই, তাই বই এর মাধ্যমে বাচ্চাদের নিজেদের মতো করে জেনে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আর কোন উপায় আপাতত দেখছি না। বাবা- মা ও কিছু বলছেন না, নিজেরা জানলে সেটার খারাপ দিক অনেক। তাই একটা বই এরকম একটা পরিস্থিতিতে আশীর্বাদ এর মতো কাজ করবে।
এবার আমার নিজের মতামত বলি, নিজেকে জানো বইটা আমি পড়েছি। যারা বই এর ভাষা নিয়ে কান্নাকাটি করছেন, তারা পারলে গিয়ে চটি পড়ে দেখেন। ঐটার ভাষা দেখলে এই বইয়ের ভাষা অমৃত মনে হবে। এখন যদি মনে হয় আপনার সন্তান বা ভাই বোন চটি পড়েই বেঁচে থাকুক, তাহলে তো আর কিছু বলার নেই। এই বইটাতে যতোটা সম্ভব বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে যৌন জীবন, বয়ঃসন্ধি এবং যৌন রোগ নিয়ে। আপনার হয়তো আপনার সন্তানকে কনডম এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানাতে বা জানতে দিতে সমস্যা থাকতে পারে, তবে যদি তার কোনদিন AIDS হয়, তার খানিকটা দায়ভার আপনার ঘাড়েও এসে পড়ে।
আর প্রিয় এই নিউজ করেছে নয়াদিগন্তের নিউজের ওপর ভিত্তি করে। নয়া দিগন্ত কোন লেভেল এর নিউজ পেপার সেটা জানা আছে, বছরের পর বছর ধরে ভুয়া নিউজ প্রচার করে কতো মানুষের জীবন গেছে এই নয়াদিগন্তের কারণে সেটার হিসেব আছে। নয়া দিগন্তকে ক্রেডিবল সোর্স হিসাবে ব্যবহার করার আর শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা রাখা একি ব্যাপার।
সেই সাথে প্রিয় নিউজের কাছেও আমার কিছু প্রশ্ন আছে। প্রিয় নিউজ কে বহু সময় মানুষ বহু ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে এর গ্রাফিকাল এক্সপ্রেশন নিয়ে। তাদের নিউজের ধরন বা শিরোনাম করা নিয়ে। প্রিয় নিউজ যদি সেই যায়গায় অটল থাকতে পারে, তাহলে আজকে তাদের এই বিষয়টা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে সমস্যাটা কোথায়? দায়সারা সংবাদ প্রচার না করে সেটার মধ্যে মিনিংফুল কিছু রাখতে সমস্যাটা কোথায়?