ভ্যাট গদ্য – উত্থান পতন কাহিনী
আমি আশা করছি সবাই এরই মধ্যে ভ্যাট এর যাবতীয় গল্প কিচ্ছা পড়ে ফেলেছেন। গতকাল ( ১০ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ) তে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ এর রিলিজ থেকে জানা গেলো ভ্যাট দিতে হবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া যাবে না, কিংবা তাদের টিউশন ফি বাড়ানো যাবে না। কিন্তু আজ বিকেল অর্থ মন্ত্রী জানান, এই বছর ভ্যাট মুক্ত থাকলেও, সামনের বছর থেকে এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হবে।
আমি গত কয়েকদিন ধরেই ভ্যাট বিরোধী এই আন্দোলন খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করছিলাম। ভ্যাট নিয়ে যে যা কিছু লিখেছি, সব পড়েছি। এবং সেখান থেকে একটা ছবি তৈরির চেষ্টা করলাম আসলে হচ্ছে টা কি ভ্যাট নিয়ে?
এখানে কয়েকটা বিষয় নিয়ে ধাপে ধাপে আলোচনা করার দরকার আছে।
- ভ্যাট কেন আরোপ হচ্ছে?
- প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের জন্য এর প্রভাব কেমন হবে?
- অর্থমন্ত্রী এই বিষয়ে কোথায় অবস্থান করছেন?
- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবস্থান কোথায়?
- এই আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রভাব কি?
- এই আন্দোলনের রাজনৈতিক ফায়দা আছে কিনা?
- আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কোথায়?
ভ্যাট কেন আরোপ করা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা আমার কাছে একদমই পরিষ্কার না। ভ্যাট, ট্যাঁক্স আদায় করা হয় সরকারের ইনকাম সোর্স হিসেবে। সেটা বুঝলাম । এখানেও হয়তো ইনকাম সোর্স হিসেবেই ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, শিক্ষাক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপ করা কতোটুকু যৌক্তিক? শিক্ষা খাতের মূল ভূমিকাই হলো শিক্ষিত একটা জাতী তৈরি করা। সেখানে প্রতিবন্ধকতা যতোটা সম্ভব কম করাটাই কি যৌক্তিক না?
তবে এখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি নিজে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছিলাম ( থাকার চেষ্টা করেছিলাম বলা উচিৎ ) । আমার অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব রয়েছে যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করে। তাদের খরচ সম্পর্কে আমার বেশ পরিষ্কার একটা ধারনা আছে। আমার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে, অনেক ক্ষেত্রেই এটা দেখে মনে হয় তারা আসলে শিক্ষাকে বাণিজ্যে রূপান্তর করেছেন।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে জানলাম অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছাত্রীদের দিনে খরচ ১০০০ টাকা। কথাটা সব দিক থেকেই অযৌক্তিক। আমি অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের চিনি যাদের দৈনিক খরচ ১০০ টাকাও না। আমরা খুব গুরুত্বপূর্ন একটা কথা ভুলে যাচ্ছি, আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর মোট আসন সংখ্যা মোট HSC পাশ করা স্টুডেন্ট এর তুলনায় একবারেই নগণ্য। ফলে যারা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পান না, কিংবা অপেক্ষা করতে চান না, তারা সরাসরি প্রাইভেট ভার্সিটিতে চলে যায়। পাবলিক ভার্সিটির সেশন জট এর কথাও মাথায় রাখতে হবে। অনেকেই সেশন জট এড়িয়ে দ্রুত পড়াশোনা শেষ করার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করে। যেহেতু আমাদের হাতে আমাদের সকল পাশ করা ছাত্রছাত্রীকে যায়গা দেওয়ার মতো সিট নেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলতে, আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যাতে তাদের শিক্ষার পথটা সুগম হয়। ভ্যাট বসিয়ে খরচ বাড়িয়ে কিভাবে সেটা করা সম্ভব, সেটা অবশ্য আমার ধারনার বাহিরে। আমি অবশ্য অর্থনীতির ছাত্র না, হয়তো আমার জানা নেই !
এবার আসি কারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করে, তাদের বিষয়ে। আমি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মাঝে একটা সুর খুঁজে পেয়েছি, যার মানে দাঁড়ায়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ যারা পড়াশোনা করে, তারা সবাই বিত্তবাব পরিবার এর সন্তান। ওয়েল, এখানে আমার কিছু কথা না বললেই নয়। আমার টিমের চারজন একটিভ সদস্যের মধ্যে দুইজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর। তারমধ্যে একজন ফ্রীল্যান্সিং করে তার পড়াশোনার খরচ চালায়, পরিবার এর ওপর চাপ কমানোর জন্য। অপরজন শুধু হাত খরচের টাকাটা পরিবার এর কাছ থেকে নেয়। বাকি সব কিছু সে নিজেই আউটসোর্সিং করে ইনকাম করে, বিশ্ববিদ্যালয় এর বিল দেয়। আমার তিন কাজিন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ে। এবং তাদের কেউই খুবী বিত্ত্বশালী পরিবার এর সন্তান নন। সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার এর সন্তান। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড সার্কেল এর অন্তত ৭ জন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ে। তাদের মধ্যে ২ জনের বাবা সরকারী চাকুরী করেন। একজনের বাবা ব্যবসায়ী, ২ জনের বাবা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করেন, ২ জনের বাবা ডাক্তার। উনাদের কেউই কোটিপতি নন। সন্তানকে মাসে ৩০ হাজার টাকা দেন না হাত খরচের জন্য। হ্যাঁ, এটা সত্যি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অনেক ছাত্র ছাত্রী পড়াশোনা করেন যাদের পরিবার অর্থশালী। কিন্তু এর মানে যে সবাই কোটিপতির সন্তান, এটা ভাবাটা নিতান্তই ভুল। আমার বন্ধুদের একজনের বাবা জমি বিক্রয় করে ছেলেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি করেছেন, সেই টাকা দিয়েই এখনো খরচ চালাচ্ছে। আমার সেই বন্ধু ঢাকায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট এ থাকে। ৪ রুমের সেই অ্যাপার্টমেন্ট এ ১৬ জন বাস করে। গড়ে এক এক রুমে ৪ জন বাস করে, একবার ভাবুন কতোটা কষ্ট হয় এভাবে থাকতে। যে মাসে ৩০ হাজার টাকা হাত খরচ পায়, সে কি আসলেই এতো কষ্ট করে থাকবে?
এই আন্দোলন একটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিলো। যাতে তাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে না হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে যখন কোন কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের পছন্দ হয় না, তখন তারা সেটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। শান্তিপূর্ন আন্দোলন। ব্যাপারটা প্রকট আকার ধারণ করে যখন ৯ / ৯ / ২০১৫ তারিখে ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ন আন্দোলনে এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠি পেটা করে এবং রাবার বুলেট ছোঁড়ে। ঠিক কি কারণে তারা এমন অ্যাকশন নিয়েছে তা আমার কাছে অজানা। ওপরের আদেশ কিংবা হুট করেই কোন পরিস্থিতির কারণে এমন হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এই সংঘর্ষে প্রায় ৩০ জন আহত হন ( নিউজ সোর্স বলছে )। এরপরই ফেসবুকে এক শিক্ষকের রক্তাক্ত ছবি ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ার দাবী করলে শিক্ষার্থীদের অনেকেই দাবী করছেন উনাদের ওপরে গুলি চালানো হয়েছে, সতি্যকারের গুলি এবং সেগুলোর একটিতেই শিক্ষক আহত হন।
আমি উনার নাম সঠিক ভাবে জানি না। তাই নাম উল্লেখ করলাম না। এই হামলার পরেই আন্দোলন বেগবান হয়। ঢাকা শহরের মোটামুটি সব গুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা সংহতি প্রকাশ করে রাস্তায় নেমে আসে। ১0 তারিখ সকাল থেকেই ঢাকার কী সব পয়েন্ট এ নেমে আসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা। রাস্তা বন্ধ করে, নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে, প্লার্কার্ড দিয়ে তারা তাদের প্রতিবাদ জানায়। ঢাকায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়, পুরো শহর প্রায় অচল হয়ে ছিলো। শেষে সন্ধের দিকে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ একটা প্রেস রিলিজ করে, যার মানে দাঁড়ায়, ভ্যাট শিক্ষার্থীদের আলাদা করে দিতে হবে না। এটা দেবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়। এবং এই ভ্যাট এর কারণে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি কোন ভাবেই বৃদ্ধি করা যাবে না।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে সব কিছুই ভালোর দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো। শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত অনেকেই চলে যেতে থাকেন, তাদের দাবী পূরণ হয়েছে বলে। আবার অনেকেই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে চান। ঠিক কোন টপিকে, সেটা অবশ্য ক্লিয়ার নন। তবে অনেকেই ছাত্রশিক্ষকদের ওপরে হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন চালাতে চান বলে অনেক জায়গায় বলেছেন। পরে পুলিশ আরেকদফা লাঠিচার্জ করে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিয়ে জায়গা খালি করার জন্য।
১১ তারিখ সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী আবার একটি অনুষ্টান এ জানান, এই বছরের জন্য ভ্যাট মাফ, তবে সামনের বছর থেকে অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাট দিতে হবে। তবে ব্যাপারটা অনেকটা কনফিউশন এর জন্ম দেয়, যখন দেখা যায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে রাজস্ববোর্ড এর বক্তব্যকেই সঠিক হিসাবে জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী ঠিক কি বলতে চাইছেন বা করতে চাইছেন, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
অনেকেই খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, ভ্যাট আন্দোলন এ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছাত্রীদের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছাত্রীরাও ফেসবুকে, অনলাইনে মৌখিক সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। সব কিছুই ঠিক কিছু, যতক্ষণ না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ওয়েবসাইট হ্যাক হয়।
সাইবার ৭১ নামের একটি হ্যাকার গ্রুপ সাইটটি ডিফেস করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে আহবান জানায় এই আন্দোলন এ শরিক হওয়ার জন্য। তাদের কমন সেন্স এর অভাবটা এখানে বেশ পরিলক্ষিত হয়। এই মূহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তির সিজন চলছে। এই মূহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সাইট হ্যাক হওয়ার অর্থ হাজার হাজার শিক্ষার্থীরার ভোগান্তি। যদিও অ্যাডমিশন পেজটা অক্ষত আছে, কিন্তু হোমপেজ এর এই অবস্থা দেখে অনেক শিক্ষার্থীই ভড়কে গেছেন। অনেকেই নানা জায়গায় পোষ্ট দিয়েছেন কিভাবে তারা তথ্য পাবেন।
সমস্যা আরেকটা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা মৌন বা মৌখিক সমর্থন দিয়ে আসছিলেন এতদিন। কিন্তু তাদের সাইট হ্যাক হওয়ার পরে বিষয়টা তাদের অনেকেটাই বিমুখী করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অনেক শিক্ষার্থীকেই অনেকে যায়গায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়, প্রচণ্ড রাগে গালাগালি করতে থাকেন অনেকে। পুরো সমস্যাটা যৌক্তিকতার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটা সরাসরি তাদের আন্দোলন নয়। শিক্ষার্থী হিসেবে অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের পাশে তারা থাকতেই পারেন, কিন্তু এভাবে বাধ্য করার চেষ্টাটা নিতান্তই বোকামি। উল্ট রিঅ্যাকশন এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অনেক জায়গায়তেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রছাত্রীদের মৌখিক ঝগড়া হচ্ছে। অথচ পুরো ঘটনাটাই পরিচিতির লোভে অযথাই সব জায়গায় নাক ভরে দেওয়া একদল ইডিয়েট এর কারণে ঘটছে। অবশ্য সাইবার ৭১ এবং এর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন এর সময়ের এই প্লাকার্ড টা নিয়ে বেশ কথা চলছে। সমস্যা হল, আমরা বাঙ্গালীরা আমাদের লজিক শুধু নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করি। “শয়তান দেহ পাবি, মন পাবিনা “, ভিলেনের খপ্পরে পরে নায়িকার এই ডায়লগ বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বিখ্যাত ডায়ালগ গুলোর একটা। বাংলাদেশে এই ডায়ালগ জানে না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। এই ডায়ালগ এর কমিক্যাল সেন্স টা আমরা সবাই জানি। কাজে অকাজে এই ডায়ালগ আমরা অনেক যায়গাতেই ব্যবহার করেছি। কিন্তু আজকে যখন এই ডায়ালগ একজন নারী সম্পূর্ন যৌক্তিক একটা আন্দোলন এ ব্যবহার করছেন, তখন সেটা নিয়ে আমাদের শালীনতার দণ্ড মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এই পর্যন্ত নাদিয়া নামের এই শিক্ষার্থীর নামে বাংলায় দেওয়া যায় এমন কোন সেক্সুয়াল গালি দেওয়া বাকি নেই পাবলিকের। অথচ অন্য কোন যায়গায় বা কোন ছেলে এই কাজ করলে আমরা হেসেই মরে যেতাম। বলিহারি আমাদের সেন্স অব হিউমার। বলিহারি আমাদের কমন সেন্স।
নাদিয়া যদি পরে এর খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উনার ভাষায় , উনি মন বলতে সমর্থন বুঝিয়েছেন। যদি ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে সমর্থন দেবেন তারা, মানে মন দেবেন। দেহ বলতে প্রাণ বুঝিয়েছেন উনি। যদি প্রত্যাহার না করে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হয়, তাহলে দেহ পেতে দেবেন উনারা বুলেটের সামনে। উনার ব্যাখ্যাটা আমার খুব মনে ধরেছে। কমিক্যাল হিউমার এর সাথে উনি ব্রেইন জুড়ে দিয়েছেন, উনাকে সাধুবাদ।
বাংলাদেশের সব আন্দোলনেই রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। শুরুতে, মাঝে কিংবা শেষে, রাজনৈতিক প্রভাব থাকেই। পক্ষে হোক, বিপক্ষে হোক। আমার মনে আছে, ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে শাহবাগে কি হয়েছিলো। রাজশাহীতে বসে তখন হাত কামড়েছি, কেন যেতে পারছি না। পুরো একটা আন্দোলন কিভাবে সামান্য একটা স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুনে রূপান্তর হতে পারে, নিজের চোখের সামনে দেখেছি। কিন্তু, সব আন্দোলন এর মতো সেই আন্দোলনকেও অনেকে প্রশ্নের সামনে দিয়ে যেতে হয়েছে। শেষে এসে নিজেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছি।
এই আন্দোলন এর রাজনৈতিক প্রভাব ও বেশ চোখে পড়ার মতই। ইষ্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রশিক্ষকদের ওপর হামলার পরেই অনেকে রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই অনেক যায়গায় ছাত্রদের সাথে নেমে পড়েন মাঠে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অনেক চেষ্টাই দেখা গেছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টিও ভ্যাট এর বিপক্ষে ছাত্রদের সাথে সমর্থ দিয়েছ বলে বার্তা দিয়েছে ( যদিও তাদের কেয়ার কেউ করে বলে আমার মনে হয়না )। বি এন পির ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীকে দেখা গেছে ছাত্রদের ভীরে। সাধারণ ছাত্রদের কাতারে দাঁড়িয়ে যদি যৌক্তিক একটা আন্দোলন এর জন্য তারা এসে থাকেন, তাহলে সাধুবাদ। যদি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হয়ে থাকে তাদের উদ্দেশ্য, তাহলে আর কিই বা বলার আছে?
একটা আন্দোলন এ সব সময় যেটা সবচেয়ে বেশি লাগে সেটা হল জনতার সাপোর্ট। যতো বেশী জনগণ আন্দোলনকারীদের পক্ষে, লক্ষে পৌঁছানো ততোটাই সম্ভব। একটা আন্দোলনের মানে হল সেখানে একটা পক্ষ অফেন্ডেড হবেই। আরেকটা পক্ষ পক্ষে থাকবে। ভ্যাট বিরোধী এই আন্দোলনকে কয়েকটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে, যেগুলো বেশ ইন্সপায়ারিং। সি এন জি ড্রাইভার রা এই আন্দোলনের পক্ষে সংহতি জানিয়েছেন এবং তাদের মতো করে প্রতিবাদ করেছেন।
কিন্তু বেশ কিছু খারাপ জিনিসও ঘটেছে। যেমন নিচের এই ছবিটি,
এই ছবির কি ক্যাপশন দেবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। “জয় বাংলা, VAT সামলা” ? কি ধরনের ফাইজলামী এটা? যে এই প্লাকার্ড টা বানিয়েছে, সে কি জানে জয় বাংলার কথাটা কি মানে বহন করে? জয় বাংলা কিসের প্রতীক?
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, ত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক জয় বাংলা। যিনি এটি বানিয়েছে, তার মাথায় যদি সামান্য কমন সেন্স থাকতো, তাহলে কখনওই এই প্লাকার্ডটা বানাতে পারতো না। এই প্লাকার্ড এর মানে হল উনি সরাসরি জয় বাংলা স্লোগানকে কটাক্ষ করছেন। “জয় বাংলা, আমরা ভ্যাট দেবো না” এই ধরনের কিছু একটা লেখা যেতো। কিন্তু যা লেখা হয়েছে, ব্যাপারটা প্রচণ্ড অফেন্সিভ। এই একটা প্লাকার্ড এর জন্য এই আন্দোলন যে কতো সমর্থক হারিয়েছে, সেটার কোন ধারনাও তাদের নেই। আমার নিজের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়েছে। নির্বুদ্ধিতার একটা লিমিট আছে।
আমি পুরো লেখাতেই বলে এসেছি, এই আন্দোলনের প্রতি আমার পুর্ন সমর্থন রয়েছে। শিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত হতে হবে। সবার জন্য সহজলভ্য হতে হবে। অযথা শিক্ষা খাটে ভ্যাট বসিয়ে শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার এর জীবন দূর্বিসহ করে তোলার কোন মানেই নেই। আমি বেশ কিছু দিন ধরেই বাইরের দেশ গুলোর শিক্ষা প্রতিষ্টান গুলোর খরচ এবং সুযোগ সুবিধে গুলো নিয়ে খোঁজ খবর করছিলাম। সারপ্রাইজড হলাম জেনে যে জার্মানীতে, আন্ডারগ্রাড থেকে শুরু করে পোষ্ট গ্র্যাড পর্যন্ত সকল ধরনের পড়াশোনায় কোন টিউশন ফী নেই, লোকাল এবং আন্তর্জাতিক ছাত্র ছাত্রীদের জন্য। আর আমরা বরং আরও ভ্যাট বসাচ্ছি। একটা শক্তিশালী দেশ গড়তে গেলে ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্টান এর কোন বিকল্প নেই। এই একটা জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এখন টাকার জন্য যদি কেউ ভালো শিক্ষা না পায়, সেটার দায় কিন্তু আমাদের সবার। সরকারের, জনগণের, সরকারের মন্ত্রীদের তো বটেই।
লেখার টাইটেল পড়েই অনেকেই হয়তো ভেবেছেন কোন মজার গল্প কিংবা জোকস হবে হয়তো। আসলে পুরো লেখাটাই এই ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন এ আমার ব্যাক্তিগত অবজার্ভেশন। এই আন্দোলন এ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার হচ্ছে, অনেকেই আন্দোলন এর লক্ষ এবং সূত্র নিয়ে আঙ্গুল তুলছেন। এই আন্দোলন এর ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো নয়। শুরুতেই এতো বেশি দিক থেকে এতো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হলে সমস্যা।
প্রচুর পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটি ঘটছে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এর মাঝে আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন তারা রবিবার থেকে আবার আন্দোলন করবেন একটানা। এরই মধ্যে দেখলাম বাংলাদেশি হয়ে পাকিস্তান সমর্থন করা এক কুলাঙ্গার এর ভিডিও নিয়ে বেশ মাতামাতি করছেন আন্দোলনকারীরা। উনাদের আন্দোলন যে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, উনারা এখনো সেটা রিয়ালাইজ করছেন না।
আমার কাছে এই পুরো লেখার পরে যে প্রশ্ন থাকে, ভ্যাট এর সংজ্ঞা হিসাবে আমি যা জানি, তাতে এটা কোন ভোগ্যপণ্য বা কমোডিটির ওপর আরোপ করা হয়। শিক্ষা প্রদান কোন ভোগ্যপণ্য না, কমোডিটি না। এটা একটা নন প্রফিটেবল সার্ভিস ( অন্তত ভার্সিটি গুলো তা বলেই রেজিস্টার করেছে )। এখানে ঠিক কি কারণে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে? আর করা হলেও অর্থনীতির ভাষায় সেটা কিভাবে করা সম্ভব, সেটাও প্রশ্নের দাবী রাখে। তবে আমি কি জানি? আমি অর্থনীতির ছাত্র না।
অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যা পরিষ্কার হওয়া দরকার । উনার বক্তব্য রাজস্ববোর্ড এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে কনফ্লিক্ট করে। আমি ৬ টা নিউজ সাইটে ছয় রকম ইন্টারপ্রেটেশন পেলাম তার বক্তব্যের। ভ্যাট কি আলাদা ভাবে নেওয়া হবে? নাকি বর্তমান টিউশন ফির মধ্যেই সেটা অন্তর্ভুক্ত আছে, ছাত্র ছাত্রীদের নতুন করে কিছু দিতে হবে না? নাকি নতুন করে দিতে হবে সামনের বছর থেকে? নাকি দিতে হবে না? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেবে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেবে না? ছাত্র-ছাত্রীদের দিতে হবে? আবার অর্থমন্ত্রী বলেছেন আপাতত নাকি “ছেলেপেলে” দের আন্দোলন এর কারণে সমঝোতা করা হয়েছে।
স্ট্রিং থিওরি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েও এতোটা কনফিউজড হয়নি যতোটা আমি এই মূহূর্তে।
শুরু থেকেই খেয়াল করে থাকবেন, আমি পাবলিক ভার্সিটি কিংবা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাইভেট ভার্সিটি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিখি নি। সব সব জায়গায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় লিখেছি। গত কয়েকদিন ধরেই দেখছি অনেকেই প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের ওভার স্মার্ট ফার্মের মুরগী বলে ঢাকছেন, তিরস্কার করছেন। আমার মনে হলো, সিরিয়াস একটা লেখার একটা স্যাটায়ার থাকা উচিৎ, একটা কমিক্যাল ভিউ থাকা উচিৎ। আফটার অল আমিও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ( ছিলাম ) । বাই দ্যা ওয়ে, আমি কোন ধরনের মুরগী খান? দেশী না ফার্মের?