ভালোবাসার সাতকাহন – ১
লেখা শুরু করার আগেই বলে নেওয়া ভালো, এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত মতামত। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে পাওয়া শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। এখানে কাউকে ব্যাক্তিগত ভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়নি। এই লেখাটি বা সিরিজটি জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবার জন্য ও সবাইকে নিয়েই লেখা। আমার সফল ও ব্যার্থ ভালোবাসার গল্প গুলো, কিছুটা সংশোধিত, পরিমার্জিত। Take it with a grain of salt if you would like, that’s entirely your choice. Happy Reading.
শ্রদ্ধেয় বড়ভাই মাশরুফ হোসেন একদা আমাকে “পাগল প্রেমিক ছোটভাই” বলেছিলেন, সংগত কারনেই বলেছিলেন। আমার জীবনের প্রেম ও প্রেমিকাদের ইতিহাস বড়ই রঙ্গিন, একইসাথে ভয়াবহও। ন্যাড়া নাকি একবার বেলতলায় যায়। আমার মাথায় বেল পড়ে ফেটেছে একাধিকবার, আমার বেল তলায় যাওয়ার শেষ হয়নি এখনো।
প্রেমে পড়ার সবচেয়ে বিরক্তিকর দিক হচ্ছে, প্রেম কাঁঠালের আঠার চেয়েও খারাপ। সুপার গ্লু যেমন একবার লেগে গেলে গেলো, টানলে ভেঙ্গে বের হয়ে আসবে। প্রেমের আঁঠা হচ্ছে চলিত বাংলায় চিটকা আঁঠা। খুলে আসার আগে টেনে ধরে থাকে সেই শক্তিতে, মাঝে আপনার মন, মেজাজ, পকেট এবং ক্ষেত্র বিশেষে গায়ের চামড়াও বিসর্জন হয় যায়।
প্রথমবার আঁঠা লেগেছিলো ক্লাস এইটে থাকতে। দেখেছিলাম তারে ইংলিশ প্রাইভেটে রুমের এক ধারে। আহা কি মায়া, আহা কি চেহারা। ক্লাস এইটের অপরিপক্ক আমি হটাৎ করেই খুব মনোযোগী হয়ে গেলাম প্রাইভেটে। ঝড় বৃষ্টি বাদল, যে মুসিবতই চলে আসুক, প্রাইভেট আমি পড়বোই, ক্লাসে আমি থাকবোই। তাকে দেখতাম অপলক চেয়ে। একদিন পড়া পারলাম না, স্যার ঝাড়ি দিলেন। দেখলাম, যার জন্য আমি উতলা, সে হাসে। নতুন একটা অনুভূতি হলো, জানলাম এর নাম প্রেমের জেদ। দেখায়ে দিতে হবে। বাংলা অংক বিজ্ঞান যাক গোল্লায়, ইংলিশে আমার ভালো হতেই হবে। জান প্রান দিয়ে ইংলিশ পড়তাম। স্যারের প্রাইভেট এ ভালো করতে শুরু করলাম। আমার এই নতুন ধনুক ভাঙ্গা পণ প্রকল্প গ্রহনের দুই সপ্তাহের মাথায় একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি সে নেই। মন আনচান করে, প্রেমিকা মোর গেলো কনে?
কয়েকদিন পর জানতে পারলাম, সরকারী চাকুরে বাবার মেয়ে এখন অন্য শহরে, তার বাবার বদলী হয়েছে। আমার অব্যাক্ত অস্ফুষ্ট ভালোবাসা সেখানেই শেষ হয়ে গেলো। তাকে আর কোনদিন দেখা হলো না, বলা হলো না। প্রথমবারের মতো “হার্টব্রেক” কাকে বলে, জানলাম। দুই একদিন উদাস থাকলাম, বন্ধু বান্ধব তখন ক্রিকেট খেলা আর সিনিয়র জুনিয়র ক্যাচাল নিয়ে ব্যাস্ত। কেউ জানলো না আমার প্রথম ভালোবাসা আর ছ্যাঁকা খাওয়ার কথা।
মাঝে পার হলো দেড়টি বছর। মফস্বল এর আমি তখন ঢাকা শহরে। এস এস সি পরীক্ষার অশনি সংকেত বাজছে। ক্লাস টেনে পড়ি। পিওর হিন্দি সিনেমার ষ্ট্যাইলে দেখা পেলাম আরেক সুন্দরীর, এবার কোচিং এ গিয়ে। কি তার চেহারা, কি তার চলন। ঢাকা শহরে নতুন গিয়েছি, জিন্স পড়া মেয়ে শুধু টিভিতেই দেখেছি এর আগে। সচক্ষে দেখলাম, জিন্স ফতুয়া পড়ে মোর হৃদয় নিয়ে খেলা করা কন্যা ক্লাসে আসে। ভয়াবহ রকমের ছাত্রী, কোচিং এর সেরা। আমি খারাপ ছাত্র ছিলাম না, তবে তার লেভেলেও ছিলাম না। কোচিং এর দুইটা ব্যাচ ছিলো, সকালে আর বিকেলে। আমাদের স্কুলের ক্লাস ছিলো দুপুর ১২ টা থেকে বিকেল ৪ টা। তার স্কুল ছিলো সকাল ৮ টা থেকে ১২ টা। সে বিকেলের ব্যাচে আসতো, আমি সকালের ব্যাচে আসতাম। শুধু শুক্রবারে সবার বিকেলে ক্লাস হতো। সপ্তাহে একদিন তাকে প্রান ভরে দেখতাম। আমাদের নির্দিষ্ট বাঁধা নিষেধ ছিলো না সকালে বিকেলে আসা নিয়ে, একই ক্লাসই হতো। এই তথ্য জানার পরে স্কুল ফাঁকি দেওয়া শুরু করলাম। তাহারে একনজর দেখার জন্য বিকেল বেলা আসা শুরু করলাম। কখনো স্কুল বাদ দিয়ে, কখনো টিফিন পালিয়ে। স্কুলে জরিমানা ছিলো, একদিন না আসলে ফাইন দিতে হতো ১০ টাকা। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে স্কুলের ফাইন দিতাম, তাকে তো দেখতে হবে।
একদিন উপরওয়ালা সহায় হলেন, ক্লাস শেষে সে আমার কাছে এসে বললো, তোমার অংক পাকা খাতা করা আছে? আজকের জেনারেশনের যারা পাকা খাতা কি জানে না, সেই আমলে আমরা বই এর সব অংক একটা খাতায় করে নোট হিসাবে রাখতাম। সব অংক। পরীক্ষার আগে একবার দেখে নিতাম শুধু। আমি অংকে বেশ ভালোই ছিলাম। অন্য সবাই পাকা খাতায় শুধু অংক করে রাখতো, আমি সুন্দর করে সাজিয়ে প্রতিটা অংকের নিচে কোন সূত্র ব্যবহার হয়েছে, ব্যাক্তিগত দুই চারলাইন মতামতও লিখে রাখতাম। আমার অংকের পাকা খাতা নিয়ে বেশ প্রাউড ছিলাম আমি। আমার স্বপ্ন কন্যা অংকের পাকা খাতা চেয়েছে, এই সুযোগ কি আর মিস করি?
দিলাম খাতা। দুইদিন পরে খাতা ফেরত দিলো সে। প্রি-টেষ্ট পরীক্ষা চলছে স্কুলে, ক্লাস প্রায় শেষের দিকে। স্কুলেও কোচিং শুরু হলো, স্কুল শুরু হওয়ার আগে কোচিং হতো, তাই টিফিনের পরে আর ক্লাস হতো না। বেশ বেশ, এখন তো কোচিং বিকেলেই করবো আমি। তাই করলাম। পাকা খাতাটা ফেরত নিয়ে আমি খুলে দেখিনি কোন কারনে। একদিন হটাৎ দেখি শেষ পাতায় সে কয়েকটা লাইন লিখেছে।
তোমার হাতের লেখা অনেক সুন্দর তো, অনেক গুছিয়ে লেখা। এতো সুন্দর করে পাকা খাতা করার আইডিয়া কোথায় পেলে?
সম্মানিত পাঠক, এই অবস্থায় আমার মনের অবস্থা কেমন ছিলো, তা প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা বাংলা ভাষার নেই। কোন ভাষারই নেই। আমি নিজেকে অনেক চালাক মনে করে পরেরদিন তাকে বললাম, তোমার পাকা খাতাটা দিয়ো তো, আমি একটু দেখবো। সে লিখে দিয়েছে, আমিও লিখবো। পেলাম খাতা, সোজা গেলাম পেছনের পাতায়। কি লিখবো ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম, সে নিজেই লিখে রেখেছে পেন্সিল দিয়ে,
এখানে কিছু লিখবা না, আমার আপু খাতা পড়ে মাঝে মাঝে আমার
মানে কি? তাহলে কি সে বুঝতে পেরেছে বেচারা আমার মনে কি চলে? তাহলে কি অবশেষে ভালোবাসা নামের নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ পেতে যাচ্ছি আমি?
সুপ্রিয় পাঠক, ভালোবাসার স্বাদ অবশেষে পেলামও আমি। টেষ্ট পরীক্ষার শেষ পরীক্ষার দিন কোচিং এ দেখা হলো তার সাথে। এর মাঝে প্রতিদিনই কথা হয়েছে, কিন্তু সবই পড়াশোনা নিয়ে, নিজের ভালোবাসার কথা বলার সাহস হয়নি আমার। সেদিন ক্লাস শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বিল্ডিং থেকে বের হয়েই তাকে বললাম একটু দাঁড়াবে? তার বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে আমার সাথে দাঁড়িয়ে রইলো। বললাম চলো তোমাকে বাসা পর্যন্ত ছেড়ে আসি। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে তার বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। হটাৎ সে এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলো, সেখানে একটা ফোন নম্বর লেখা।
এটা আমার নম্বর, বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে। তবে রাতে মাঝে মাঝে চালু করি। তোমার নম্বর দাও, ফোন চালু করলে মিসকল দেবো তোমাকে।
বলছি আজ থেকে এক দশকেরও বেশি আগের কথা। সেই সময় আমাদের ব্যাক্তিগত ফোন সেভাবে ছিলো না বললেই চলে। বাড়ির বড় কেউ নতুন ফোন কিনলে তার আগের ফোনটা আমরা দখল করতাম, লুকিয়ে লুকিয়ে সিম কিনে সেই সিম ঢুকিয়ে মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলতাম। ডুজুস, একটেল জয় এর যুগে কেবল প্রবেশ করেছি আমরা। ওয়ারিদ তখনো এয়ারটেল হয়নি, বাংলালিংক তখন বেশ চলতো। আর ডিজুস এসে সারারাত ফ্রী অফার দিয়ে পুরো দেশ মাতিয়ে রেখেছিলো। জমানো টাকা, ঈদের বোনাস ইত্যাদি দিয়ে ফোনে রিচার্জ করতাম, তখন ২০ টাকার কার্ড সবে নেমেছে, সব দোকানে পাওয়া যেতো না। ফ্লেক্সিলোড তখনো সেভাবে জমে ওঠেনি, কার্ড দিয়েই টাকা তুলতে হতো।
প্রতিদিন রাতে অপেক্ষায় থাকতাম, তখন সে মিসকল দেবে, কখন কথা হবে। কেউ কাউকে বলিনি ভালোবাসি। কিন্তু অজ্ঞাত ভাবে যেন আমরা দুজনেই জানতাম, একে অপরকে ভালোবাসি। এরপর কোন এক মুহুর্তে ফোনে মিসকল আসতো। মিসকল দেওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। বাসায় অভিভাবক রা আছেন। বড় ভাই বোন আছেন। ফোনে রিংটোন বাজলে সমস্যা। সাইলেন্ট করা ফোনে এতো সুক্ষ ভাবে মিসকল দিতাম, যেন লাইট জ্বলেই কল কেটে যেতো।
কথা হতো আমাদের। আমি বারান্দায় গিয়ে মেঝেতে বসে বসে নিচু গলায় কথা বলতাম। সে তার বিল্ডিংয়ের সিড়িঘরে গিয়ে কথা বলতো। আমি বলতে নিজের কথা, তার কথা। সে বলতো পড়াশোনার কথা। মাঝে মাঝে হেসে উঠতো আমার কথা শুনে। আমি চুপ করে শুনতাম, আহা সে হাসি।
এই সুখ বেশিদিন সইলো না, এলো এস এস সি পরীক্ষা। নামে মুখে দম তুলে পড়া চলছে। ভাগ্যক্রমে তার আমার একই কেন্দ্রে আলাদা আলাদা রুমে সিট পড়লো। শুধু হায়ার ম্যাথমেটিক্স এর দিন একরুমে সিট পড়লো। আমার আনন্দ দেখে কে, তাকে দেখেই যেন হায়ার ম্যাথ পরীক্ষা আরো ভালো হলো। পরীক্ষা শেষে তার বোন বা বাবা বা মা বাইরে থাকতো তাকে নেওয়ার জন্য। আমার সাথে আম্মু আসতো বেশিরভাগ দিনই, দুই একদিন একা।
প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার মতো নির্দিষ্ট সময় দেওয়া ছিলো না শেষ হওয়ার। সকালে বা দুপুরে শুরু হয়ে চলতো। আমরা কেন্দ্রের বারান্দার বসে গল্প করতাম। শেষ প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার দিন সাহস করে তার হাত ধরেছিলাম, ৪-৫ মিনিট হাত ধরে হেঁটেছিলাম। সেই তার সাথে শেষবার দেখা আমার।
পরীক্ষা শেষে সে একগাদা এইচ এস সি’র বই কিনে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলো ঘুরতে। আমরা সবাই যখন ছুটি কাটানোর ধান্দায়, সে তখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো আবার। গ্রামের বাড়িতে ফোনের নেটওয়ার্ক ছিলো না ঠিকমতো, মাঝে মাঝে বাহিরে এসে দুই চারমিনিট কথা হতো, এটুকুই। তাও ২-৩ দিনে একবার। এভাবেই প্রেম করলাম দেড় মাস। রেজাল্ট হলো। সে বোর্ডে প্লেস করলো, আমিও ভালো করলাম, তবে এতোটা না।
সে হলিক্রসে ভর্তি হলো, আমিও ভর্তি হয়ে আসলাম একটা কলেজে, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ভর্তির পরের দিন জানতে পারলাম আমাকে ঢাকা থেকে রাজশাহী শিফট হতে হবে। আমার পরিবার রাজশাহী চলে আসছে। তাকে দেখার জন্য প্রান কাঁদছিলো। তার ফোনও বন্ধ, কোচিং ও নেই যে দেখা হবে। ৬ দিনের নোটিশে আমরা রাজশাহী চলে আসলাম, আসার আগেরদিন তার বাসার সামনে গিয়েছিলাম, যদি একবার কোনভাবে দেখা হয়ে যায়। হয়নি।
রাজশাহী চলে এলাম। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। কিছুতেই মন বসে না, কিছুই ভালো লাগে না। ঢাকার বন্ধুমারফত জানতে পারলাম, তার ফোন হারিয়ে গেছে, আমার নম্বর নেই তার কাছে। রাজশাহী আসার প্রায় একমাস পরে একদিন সে তার বোনের ফোন থেকে ফোন দিলো, তার সাথে শেষবারের মতো কথা হলো। লং ডিসট্যান্স রিলেশন কি জিনিসটা আমরা জানতাম না, জানার মতো সুযোগও ছিলো না। ভালোবাসা ছিলো শুধুই ফোন কলে।
প্রথমবারের মতো সত্যিকারের হার্টব্রেক হলো আমার। আসার আগে তার সাথে দেখা হলে তাকে দেওয়ার জন্য বিশাল ১১ পেজের একটা চিঠি লিখেছিলাম, নিজের ভালোবাসার কথা বলেছিলাম সেই চিঠিতে। আগুন জ্বালিয়ে সেই চিঠি পুড়িয়ে দিলাম একদিন।
শুরু হলো আমার রাজশাহীর অধ্যায়। যেখানে ন্যাড়া ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ট এবং আরো অনেকবার বেলতলায় গেছে। [ চলবে ]
আঁতেলের ডায়েরী / আঁতেলের ভালোবাসা – ১ / আঁতেলের ভালোবাসা – ২