বোকা রাজপুত্র – ভালোবাসার গল্প
হারমান মেইনার এর ক্যাম্পাস। প্রচন্ড ব্যাস্ত সবাই। শিক্ষা সফরে যাবে ওরা। তাও আবার কুয়াকাটা। এবারের সফরটা একটু স্পেশাল কারন সাধারনত শিক্ষাসফর একদিনের হয়। কিন্তু এটা তিন দিনের। রাতে রওনা দিয়ে ওরা সকালে পৌছাবে। দুইদিন থাকবে এবং আবারো রাতে রওনা দিয়ে সকালে ঢাকা পৌছাবে। তিনটা বাস, ১০০ জন ছাত্রছাত্রী যারা বাসা থেকে অনুমতি পেয়েছে এবং ১৬ জন শিক্ষক। সাথে কাজের সুবিধার্থে বাবুর্চি, আর্দালিদের নেওয়া হয়েছে। সবাই যার যার মতো প্রস্তুতি তে ব্যাস্ত। এতো ভীরের মধ্যে দুইটা মানুষকে লক্ষ করলে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যাবে। অবশ্যই তাদের বৈশিষ্টগত কারনে। একজন এতো লোকের মাঝে একা বলে, অন্যজন গ্রুপ ধরে আড্ডা দিচ্ছে বলে। একা চশমা পরে যে ছেলেটা বসে আছে তার নাম অরাভ। অরাভ আহমেদ। ইন্টালেকচুয়াল জিনিয়াস যাকে বলে। পড়াশোনায় ভালো। একটু বেশিই ভালো। কিন্তু প্রচন্ড আত্নকেন্দ্রিক। বন্ধুবান্ধব নেই বললেই চলে। তারওপর অরাভ আবার বাবা-মার আদরের দুলাল। তাকে ক্লাসে পৌছে দেওয়া থেকে শুরু করে তার সব কাজে বাবা অথবা মা, কাউকে দেখা যায় সর্বদা। তারা কেন যেন মনে করেন কলেজ এ পরা অরাভ আসলে এখনো অনেক ছোট। একা চলাফেরা করতে পারবে না। যদিও এর পেছনে অনেক কারন আছে। অন্যদিকে অরাভের বাবা বাংলাদেশের একজন নামী দামী শিল্পপতি। অত্যন্ত ভালো মানুষ। উনার নিজের কতো টাকা আছে উনি নিজেও জানেন না। সন্তান একটাই। তাই হয়তো একটু বেশি বেশি করেন। ও, হ্যাঁ, আরেকজনের সাথে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি। সিড়ির কোনায় দল বল নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন তিনি। শ্যামলা বর্নের সুন্দর এই মেয়েটির নাম আফরিন। আফরিন অদিতি। যদিও সবাই তাকে অদিতি বলেই ডাকে। পরিবার অত্যন্ত সাহিত্য অনুরাগী হলেও মেয়ে হয়েছে পুরো ঊল্টো। পুথিঁগত জিনিস তার একদম ভালো লাগেনা। বরং গানে গাইতে ভালো লাগে। অসম্ভব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, সাথে কলেজ এর সকল ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ এ সবার আগে আফরিন কেই পাওয়া যায়। স্যারেদের প্রিয় ছাত্রী এবং ক্লাস ক্যাপ্টেন। আফরিন এর পরিবার মধ্যবিত্ত। সচ্ছল অবশ্যই।
সমস্যা হলো কলেজের এর দুই ষ্ট্যারের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা দা কুড়ালের মতো। একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারে না। অরাভ আফরিন কে সহ্য করতে পারে না কারন আফরিন অনেক বেশি চঞ্চল, বেশি কথা বলে এবং পড়াশুনা নিয়ে মাথাব্যাথা কম। আর আফরিন অরাভ কে সহ্য করতে পারে না কারন তার মনে হয় অরাভ আসলে মেরুদন্ডহীন একটা মানূষ, যে নিজে কিছু করতে পারে না, মানুষের সাথে মিশতে পারতে না, কোন বন্ধুবান্ধব নাই, সারাদিন বই আর পিসির মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকে!
তবে মাঝে মাঝে ভাগ্যও আজব খেল খেলে। প্রথম দুইটা বাসের একটা ছাত্র, এবং অন্যটাতে ছাত্রী তোলার পর দেখা গেলো ৪২ সিট এর দুইবাসে ৮৪ জন বসেছে। যারা বাকি রয়েছে তারা শেষ বাসে টিচার এবং জিনিসপত্রে সাথে। দেখা গেলো সেখানে অরাভ আফরিন দুইজনেই আছে এবং দুইজনের সিট পাশাপাশি পড়েছে ! আফরিন আগেই উঠে বসেছিলো। অরাভ এসে নিজের সিট খুঁজে নিয়ে সেখানে আফরিন কে দেখে মনে মনে রেগে গেলো। সে এই বাচাল মেয়ের পাশে বসতে চায় না। অন্যদিকে আফরিন ও অরাভ কে দেখে ক্ষেপে গেলো। এই মেরুদন্ডহীন মানুষের সাথে বসার কোন মানে নাই। দুইজনের প্রায় একইসাথে টিচারের কাছে আবেদন করলো সিট পাল্টে দেওয়ার জন্য। সিট ম্যানেজমেন্ট এর দ্বায়িত্বে ছিলেন বায়োলজির শাহানা ম্যাডাম। উনি দুইজনের শত্রুতার কথা ভালো ভাবেই জানতেন। উনি সিট চেঞ্জ করে দিলেন না। এদিকে আফরিন এর বাসে উঠলে পেট্রোল কিংবা ডিজেলের পোড়া গন্ধ সহ্য হয়না। বমি আসে। তাই সএ জানালার ধারের সিট আগে দখল করেছে। এদিকে অরাভ ও ওর সাথে ঝগড়া শুরু করেছে জানালার ধারে সিট নেবে বলে। ম্যাডাম এগিয়ে এসে বললেন আফরিন মেয়ে এবং তাই সে জানালার ধারে সিট পাবে। অরাভ রাগে গজ গজ করতে করতে সিটে বসে পড়লো। বাস ছেড়েছে। কিছুদূর যেতেই দেখা গেলো সবাই ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করেছে। অরাভ নিজের সিট একটু পেছনে হেলিয়ে দিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো। অন্যদিকে আফরিন নিজের সেলফোন বের করে গান শুনছে। অরাভের যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন ভোরে হয়ে গেছে। সূর্য আকাশে উদিয়মান। পাশের সিটে তাকিয়ে দেখে হেডফোন কানে লাগিয়েই ঘুমাচ্ছে আফরিন। অরাভ একটু হাসলো। ধিরে ধিরে বললো কতো বড় ইডিয়েট। কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে। অরাভ সম্ভবত কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছে। আফরিন চট করে চোখ খুলে ওর দিকে তাকালো। চোখ গরম করে বললো ‘কিছু বললে তুমি?’। আফরিনের তাকানোর এই ভঙ্গি দেখে অরাভের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে এবার ওর সামনেই বললো ‘ একমাত্র ইডিয়েটরাই কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুমায়, এটা কানের জন্য ক্ষতিকর ‘। আফরিন চটে গিয়ে বললো ‘ শোণ মিষ্টার আলালের ঘরের দুলাল, আমি ঘুমাচ্ছিলাম না, অনেক আগেই উঠেছি আমি। তোমার মতো সোনার পালঙ্কে শুই না আমি, গাধার মতো ঘুমাই না’। ওর এই কথায় অরাভ চটে গিয়ে কিছু বলতে যাবে, টিচার এসে ওদের থামিয়ে দিলেন কারন ওদের এখন লঞ্চে ওঠার সময় হয়ে গেছে। যে যার ব্যাগ টানতে টানতে লঞ্চের দিকে চললো।
লঞ্চে ওদের সকালের খাবার সার্ভ করা হলো। অরাভ এর বাসা থেকে সঙ্গে কিছু খাবার দিয়েছিলো। অরাভ সেই খাবার বের করে খেতে লাগলো। এটা দেখে আফরিন ওকে কটাক্ষ করে বললো ‘ এই যে নবাবজাদা সাহেব খাচ্ছেন, তাকে বাসা থেকে খাবার দিতে হয়, নাইলে তার পেট খারাপ করবে’। অরাভ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চায় না। তাই সে অন্যদিকে ঘুরে খেতে লাগলো। এদিকে আফরিনের মাথায় জেদ চেপে গেছে। ছেলেটা ওকে ইগনর করবে কেন? সে আবার বললো ‘ এই কেউ উনাকে একটা চামচ দে রে, উনি হাত দিয়ে খেতে পারেন না, উনাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয় ‘। এবার অরাভের এতো রাগ হলো যে চট করে পেছনে ঘুরতে গিয়ে আফরিন এর সাথে ধাক্কা খেলো এবং আফরিনের খাবার হাত থেকে লঞ্চের ডেকে পরে গেলো। আফরিন প্রচন্ড অবাক হয়েছে। এদিকে এক টিচার এটা দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। আফরিন অভিযোগ করতে গেলে উনি বললেন ‘ আমি অরাভের কোন দোষ দেখি না, তুমি ওকে ক্ষেপাচ্ছিলে, এখন নিজেই সাজা পেয়েছ।’ আফরিন কে নতুন করে খাবার দিতে চাইলে সে রাগে নিলোনা। কিন্তু কিছুক্ষন পর আফরিন বুঝতে পারলো আসলে তার খাবারটা নেওয়া উচিৎ ছিলো কারন তার ব্যাপক ক্ষুধা লেগেছে। টিচার কে কিছু বলতেও পারছে না, সম্মানে বাধে, একবার যেহেতু খাবার নেয়নি।
অরাভ লঞ্চের ডেকে দাড়িয়ে একটা বই পড়ছিলো। এটা অরাভের একটা গুন যে যে কোন পরিস্থিতিতে ওর পড়াশুনা করতে কোন সমস্যা হয় না। ও হটাৎ খেয়াল করে দেখলো আফরিন রেলিং এর ধারে দাড়িয়ে আছে। চেহারা অনেক শুকনো লাগছে। অরাভের একটু খারাপ লাগলো। তার এভাবে রি-অ্যাক্ট করাটা ঠিক হয়নি বুঝতে পারলো। কিন্তু একখন কি করবে বুঝবে পারছে না। ব্যাগে একটা বার্গার আছে। সাত-পাঁচ ভেবে শেষে সে খাবার টা নিয়ে এগিয়ে গেলো আফরিন এর দিকে। আস্তে করে বাড়িয়ে দিলো সামনে। আফরিন আপন মনে কি যেন ভাবছিলো। হটাৎ সামনে কিছু আসায় চমকে উঠলো। দেখে অরাভ একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছ ওর দিকে। আফরিন এক মূহূর্ত ভাবলো নেবে কিনা। পরে ক্ষুধার কাছে হার মানলো। প্যাকেট টা নিয়ে চলে গেলো। এবার অরাভের রাগ হলো ! আজব মেয়ে, একটা ধন্যবাদ ও দিলো না? এই জন্য যেচে পরে সাহায্য করা উচিৎ না।
লঞ্চের ডেকের আরেক মাথায় দাড়িয়ে সবটাই খেয়াল করলো শাহানা ম্যাডাম এবং জলিল স্যার। উনারা স্বামী-স্ত্রী। একই প্রতিষ্টানে চাকরী করেন। একজন বায়োলজী একজন ফিজিক্স। শাহানা ম্যাডাম একটা হাসি দিয়ে জলিল স্যারের দিকে তাকিয়ে বললো
> কিছু বুঝলে?
> হুম, আমাদের মতো অবস্থা। আমরাও তো কলেজ লাইফে এমন ছিলাম।
> কত্তো মান অভিমান ছিলো, এখন মনে পরলে হাসি পায় জলিল।
> হ্যাঁ, আচ্ছা তোমার মাথায় কি কিছু কাজ করছে?
> হুম, ওদের মধ্যে একটা কার্বন বণ্ড বানাতে হবে।
> শাহানা, রাখো তোমার বায়োলজি। প্রেম কেমিষ্ট্রির বিষয়।
> আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। এখন কি করবে বলো?
> যা করার। একটা প্লান আছে। শোন।
জলিল স্যার নিজের প্লান বর্ননা করা শুরু করলেন, অন্যদিকে অরাভের বইয়ের কয়েক পৃষ্টা পড়া শেষ হলো, একটা মজার জিনিস পরে সে আপন মনে হাসছে। অন্য একপাশে আফরিন বার্গারটা শেষ করে ভাবছে অরাভ ছেলেটা নিতান্তই খারাপ না !
সফরের মধ্যে কিছু গেম ইভেন্ট রাখা হয়েছে যেখানে সব টিম ওয়াইজ করতে হবে। দুইজনের একটা টিম। জলিল স্যারের প্লান অনুযায়ী আফরিন এবং অরাভ দুইজনে মিলে এক টিম। দুইজনেই এই কথা শুনে প্রচন্ড হতাশ। আফরিন এবং অরাভ আলাদা ভাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রচন্ড সফল। কিন্তু একসাথে !!! কক্ষনো না !
প্রথম ইভেন্ট ছিলো তীরে বালি দিয়ে একটা ছোট মনুমেন্ট মডেল বানাতে হবে। বালি ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা যাবে না। আফরিন আর অরাভের মতের মিল হচ্ছে না। অরাভের কথা হলো একটা প্রাসাদ বানাবে, বাহিরের দেশে বালির মধ্যে এসব বানানো হয়, সে বইয়ে পড়েছে এবং নেটে দেখেছে। অন্যদিকে আফরিন এর বক্তব্য হলো একটা বাড়ি বানাবে দেখতে অনেকটা গ্রামের বাড়ির মতো। একপর্যায়ে দেখা গেলো ইভেন্ট শেষ হতে আর আধা ঘন্টা আছে অথচ ওরা এখনো ডিসাইড করতে পারে নাই কি বানাবে। অবশেষে অরাভ বুদ্ধি দিলো যে এমন একটা প্রসাদ বানানো হোক যার একটা পাশে একটা গ্রামের বাড়ি থাকবে। বানাতে শুরু করার পরে অরাভ প্রায় ওর প্রাসাদ শেষ করে এনেছে, এমন সময় অসতর্কতা বশত আফরিন এর হাত লেগে পুরোটাই ভেঙ্গে গেলো। অরাভের মাথা এতো গরম হলো যে রাগ করে এক লাথি দিয়ে আফরিন এর ঘর ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলো। দেখা গেলো প্রথম ইভেন্ট এ ওরা কোন মার্ক পায়নি। জলিল স্যার তিরস্কার করলেন ‘ তোমরা সব কিছুতে ফার্ষ্ট আর এই খানে একদম জিরো? এটা আশা করিনাই ‘।
পরের ইভেন্ট ছিলো তীরে দাড়িয়ে সামনে যা দেখা যাচ্ছে তার ছবি আঁকতে হবে। অরাভের বক্তব্য হলো ছবিটা ও শুধু পেন্সিল স্কেচ দিয়ে আঁকবে। আর আফরিন এর বক্তব্য হলো সে এটা রং ছাড়া আঁকবে না ! এই নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে ক্যানভাস এ রং পড়ে গেলো। পুরো ছবিটাই শেষ। এবার অরাভ রাগ করে চলে গেলো। দূরে গিয়ে একটা মরা গাছের ওপর বসে রইলো। আফরিন কিছুক্ষন ক্যানভাস এর সামনে দাড়িয়ে রইলো। এরপর কি মনে করে ধিরে ধিরে অরাভের দিকে এগিয়ে গেলো। পাশে গিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষন।
আফরিন বললো
> অরাভ?
> বলো।
> তুমি আমাকে ঘৃনা কর তাইনা?
> মিথ্যে বলবো না, আমি মিথ্যা বলি না। হ্যাঁ, করি।
> কেন?
> ঠিক জানিনা। তবে মনে হয় তোমার অতিরিক্ত চঞ্চল স্বভাবের জন্য।
> তুমি জানো আমি এতো চঞ্চল কেন?
> এর আগে আমাদের ঠিকমতো কথাই হয়নি। জানবো কেমন করে তুমিই বলো?
> অরাভ, আমার বয়স যখন দশ বছর, তখন আমার মা মারা যায়। সেই কষ্ট গুলো ভূলে থাকার জন্য আমি সব সময় আনন্দে থাকার চেষ্টা করি।
> I am sorry
> Don’t be. এতে তোমার কোন দোষ নেই, তুমি জানো আমি তোমাকে কেন ঘৃনা করি?
> না।
> আমার মা মারা গিয়েছিলেন বাবার অবহেলার ফলে। বাবা টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে স্ত্রী সন্তান সব কিছুকে পেছনে ফেলে টাকার নেশায় মত্ত হয়ে ছিলেন। অসুস্থ স্ত্রীর কাতরানী কিংবা ছোট্ট মেয়ের কান্না কোনটাই তিনি দেখেন নাই। তাই আমি টাকা ওয়ালা মানুষদের পছন্দ করি না।
> আফরিন, একটা মজার ব্যাপার হলো, আমার বাবা-মা যে আমার এতো কেয়ার করেন সেটার কারন কিন্তু শূধুমাত্র আমি তাদের সন্তান তা নয়। বাবা-মা সন্তান নিতে পারছিলেন না। অনেক চিকিৎসার পর মেডিকেল বোর্ড বলে যে উনি মাত্র একবার ই গর্ভধারন করতে পারবেন। সেটাও অনেক বয়সে। ফলে আমি শারিরীক ভাবে কিছুটা দূর্বল ছিলাম ছোট বেলায়। তারওপর এতো সাধনার সন্তান। উনারা আর কোনদিন সন্তান ও নিতে পারবেন না। এই কারনেই উনারা আমার এতো কেয়ার করেন।
আফরিন কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,
> শত্রুতা তো অনেক হলো, কলেজ এ আমরা দুইজনই নিজ নিজ কাজে সব সময় প্রথম হয়েছি। আজকে না হলে মান-সম্মান থাকবে না।
অরাভ মুচকী হেসে বললো।
> চলে তবে এখানেও জেতার চেষ্টা করি।
কেউ হয়তো জানলো না, কেউ বুঝলো না। কিন্তু মাত্র কয়েকটা বাক্য বিনিময়েই ওদের মাঝের সম্পর্কটা অনেক বেশি সহজ হয়ে গেলো। কেউ না বলে দিলেও ওরা নিজেরাও বুঝতে পারছে, কয়েকমূহূর্তের মাঝেই বন্ধুত্বের বীজ ওঠা শুরু হয়েছে।
অরাভের ছবি আকার হাত বরাবরই ভালো। তাই আফরিন ক্যানভাস অরাভের হাতে ছেড়ে দিলো। পাশে দাড়িয়ে মন্তব্য করতে লাগলো, নানা ধরনের সাহায্য করতে লাগলো। রং ছাড়াই শুধু পেন্সিল দিয়ে অরাভ অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য আঁকলো। আফরিন একটু দূরে দাড়িয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে মন্তব্য করলো
> খাসা এঁকেছেন মশাই !
তারপর দুইজনেই হাসতে লাগলো । ওরা কেউ খেয়াল না করলেই দূরে দুই জোড়া চোখ ওদের লক্ষ করছে। সেই চোখের মালিকদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
আফরিন আর অরাভ এক হওয়ার পর যেন বিজয় রথের যাত্রা শুরু। চিত্রাংকন এ প্রথম হলো ওরা। এরপরের খেলা ছিলো কুশন চেয়ার। অনেক গুলো চেয়ার নিয়ে সবাই গোল হয়ে বসবে। মিউজিক বাজবে। একটা কুশন দেওয়া হবে। কুশন টা সবাইকে পাশের জনের হাতে পাস করতে হবে। যার হাতে থাকা অবস্থায় মিউজিক বন্ধ হবে তাকে একটা প্রশ্ন করবে। সে উত্তর দিতে পারলে টিকবে, নাহলে বাদ। শেষে দেখা গেলো আফরিন আর একটা মেয়ে। প্রতিবার একজন করে বাদ পরার পর প্রশ্নের টপিক চেঞ্জ হচ্ছে। একেবার একে স্থান থেকে। কখনো রাজনীতি, কখনো সমাজ, কখনো বিজ্ঞান, কখনো সংস্কৃতি। এর আগেও আফরিন এর হাতে দুইবার কুশন গেছে। আফরিন সঠিক জবাব দিয়ে উৎরে গেছে। অরাভ পাশে সবার সাথে দাড়িয়ে খেলা দেখছে। এবার প্রশ্ন এলো আফরিন এর জন্যঃ কুসুম্বা মসজিদ যেটা নওগাঁয় অবস্থিত, সেটা কোন মুসলিম নেতার শাসনামলে বানানো হয় এবং কে বানিয়েছিলেন? উত্তর দেওয়ার সময় এক মিনিট। আফরিন পড়েছে অকুল পাথারে। এই প্রশ্নের উত্তর ওর ঠিক জানা নেই। আবছা আবছা ভাবে একটা নাম মনে আসছে কিন্তু সেটা মনে করতে পারছে না। আর মাত্র তিরিশ সেকেন্ড। এদিকে হটাৎ আফরিন খেয়াল করলো অরাভ ওকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু অনেক দূরে আছে + জোরে বলার উপায় নেই। অরাভ ওকে হাত দিয়ে কিছু একটা দেখাচ্ছে। ভালো করে দেখলো একটা ছেলেকে দেখাচ্ছে। কেন? আফরিন বোঝার চেষ্টা করছে ছেলেটাকে দেখানোর কারন কি? হটাৎ করেই আফরিন রহস্যটা ধরতে পারলো। ছেলেটার নাম। ছেলেটার নাম সোলাইমান। অরাভ ছেলেটার নামের দিকে ইংগিত করছে কারন কুসুম্বা মসজিদ সুলায়মান নামের এক ব্যাক্তি প্রতিষ্টা করেন। সেই সময়ের শাসন কর্তার নাম ও মনে পড়ে গেলো। গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ। আফগান শুর বংশের শেষ দিকের শাসক। ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করলো আফরিন এর। মাত্র পাঁচ সেকেন্ড বাকি থাকতে জবাব দিলো। অপর মেয়েটা পরের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে হেরে গেলো। আফরিন জিতে গেলো। খেলা শেষে হাসতে হাসতে অরাভের দিকে গিয়ে বললো ‘ চিটিং?’ অরাভ চোখটিপে বললো ‘ এভরিথিং ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার ‘। দুইজন হাসতে হাসতে চলে গেলো। সেই চোখ জোড়া এখনো ওদের খেয়াল করছে ।
এরপরের প্রতিযোগীতা ছিলো ছাত্রদের বনাম টিচারদের ভলিবল। অরাভ এমনিতেই ঘরকুনে স্বভাবের। সে এসব খেলা পারে না। নিয়ম কানুন জানে, কিন্তু কোনদিন ও খেলেনি। আর এই খেলা একটা ফ্রেন্ডলী কম্পিটিশন। এটার কোন পুরুষ্কার নাই। আফরিন জোর করে পাঠালো অরাভ কে। অরাভ প্রথম দিকে একটু আড়ষ্ট ভাব করলেই এরপর ভালো মতোই খেলতে লাগলো। ওর একটা স্ম্যাশ দেখে সবাই এই ছেলের গায়ে যে এতো শক্তি আছে কেউ ভাবেই নি। অরাভ নিজেও অবাক। কিন্তু খেলতে খেলতে এক পর্যায় এ এসে অরাভ একটা রিভার্স শট নিতে গিয়ে পেছন উল্টে পড়ে গেলো। পা কেটে গেলো। যে টিচার মেডিক এর দ্বায়িত্ব পেয়েছিলেন, উনি ফার্ষ্ট এইড বক্স নিয়ে ছুটলেন। আফরিন এগিয়ে এসে বলতে গেলে একপ্রকার বক্স টা কেড়ে নিয়ে নিজেই অরাভের পা ব্যান্ডেজ করে দিলো।
সেদিনের শেষ প্রতিযোগীতা ছিলো কবিতা আবৃত্তি। আফরিন ভেবেছিলো এইটাতে ওরা অংশগ্রহন করতে পারবে না কারন আবৃত্তি করবে কে? কিন্তু অরাভ কে ওদের নাম এন্ট্রি করতে দেখে ভাবলো হয়েছে এইবার, মান সম্মান যাবে। ক্যাম্প ফায়ার এর আলো, পেছন সমুদ্রের গর্জন, অদ্ভুত এক পরিবেশ। অরাভ উঠে গিয়ে সবার মাঝে দাড়ালো আবৃত্তি করার জন্য। অরাভের গলার স্বর যেন হটাৎ করেই বদলে যায়। কেমন ভরাট হয়ে যায় ওর গলা।
অন্ধকার রাত, মাঝে কিছুটা বর্নহীন কুয়াশা,দূরে শোনা যায় হায়নার ডাক,
বিজলী চমকায়, চমকে ওঠে পথিক, শিহরিত শরীর, দূরে কে দেয় হাঁক?
পথের মাঝে ছোপ ছোপ রক্ত, একটুকরো আলোর খোঁজে নিঃস্ব মানুষের হাহাকার,
পথের ধারে মাংসহীন কংকাল, হাসে মনিহীন চোখে, জীবনের লক্ষ আজ নিরাকার।
ক্লান্ত পথিক পিপাসার্ত, খোঁজে একটু খানি পানি, নেই নেই, কোথাও নেই, কিচ্ছু নেই,
তবে কি এখানেই পথিকের যাত্রার সমাপ্তি, এখানেই কান্নার শুরু, ভূলেছে প্রতিজ্ঞা সেই?
পিপাসার্ত ক্লান্ত পথিক, উঠে দাঁড়ায়, সেই প্রতিজ্ঞা আজো অম্লান, এক সৈনিকের চোখে,
তবু পৌছাবে সে বার্তা, তবু দেখাবে আসার আলো, বলবে সত্য, সাহস কার রূখে?
শেষ রক্তবিন্দুর প্রানে, পথিকের যাত্রার সমাপ্তি, এসেছে মানবদ্বারে, নিয়ে সুসংবাদ,
শুধায় মানবশিশু, কি এনেছ হে আমার জন্য, ক্লান্তব পথিক, কি এনেছ হে আশীর্বাদ ?
ধির কিন্তু বজ্রকন্ঠে বলে পথিক, জানিয়ে দাও মানবতাকে, এসেছে শুভদিন, বিজয়,
এসেছে মানবতার চরম জয়, পেয়েছে জীবনের লক্ষ, আজ তবু নেই কোন ক্ষয়।
আবারো শুধায় মানবসন্তান, কিসের বিজয়? কিসের লক্ষ, করো মোরে বর্নন,
বলে পথিক, উঠেছে প্রেরনার সূর্য, এসেছে ভালোবাসার বসন্ত, ঝরছে মানবতার শ্রাবন।
আজ শুনেছি আমি মানবতার কন্ঠ, বলেছে, এ জীবন লক্ষহীন নয়, এ জীবন মূল্যবান
প্রতিটি ক্ষনে আছে বিপদ, আছে শত্রু, বাধা পেরিয়ে গাইতে হবে মানবতার জয়গান।
উঠে দাঁড়ায় যুবক, হাতে পথিকের মৃতদেহ, শয়ন করিয়ে দেয় অন্তিম শয়নে, ভালো থেকো
তুলে নেয় পথিকের দীক্ষা, বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে, পথে ভয়, আছে মানুষখেকো,
তবু আর খুঁজে বেড়াবে স্বজাতির করোটি, ফেরাবে প্রান, দেবে সুসংবাদ, গাইবে মানবতার জয়গান,
শেষ প্রান্তরে এসে মুখোমুখি মিথ্যে বনাম মানবতা, অন্ধকার বনাম জীবন, হয় বিজয় নাহয় প্রান।
কবিতাটা শেষ করার পর চারেদিক তালিতে ফেটে পড়লো। অরাভ যখন জানালো কবিতাটা ওর নিজের লেখা, সবাই আরো অবাক হলো। এরকম একটা কবিতার পরে আসলে কারও চান্স ছিলো না। এবারো অরাভ- আফরিন জুটি প্রথম।
ওরা যেখানে ক্যাম্প করেছে তার ঠিক পাশেই একটা মার্কেট। শামুক-ঝিনুক জাতীয় জিনিসের তৈরী অনেক অর্নামেন্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। কবিতা প্রতিযোগীতা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ৭টা থেকে ৮টা, এক ঘন্টা সময় দেওয়া হলো ওদের চারপাশ ঘুরে দেখার জন্য। তবে দলবদ্ধ ভাবে। প্রতিটা দলে একজন টিচার যাবেন। অরাভ আফরিন শাহানা ম্যাডামের দলে মার্কেটে ঘুরতে গেলো। আফরিন হটাৎ কানের দুলের একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। অনেক গুলো দূলের মাঝে কোনটা আসলে ভালো সে ঠিক করতে পারছিলো না। অরাভ হটাৎ একটু দূল ডিসপ্লে থেকে তুলে দিনে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। আফরিন দেখলো অরাভের পছন্দ আসলে খারাপ নয়। দূর থেকে শাহানা ম্যাডাম সবই খেয়াল করলেন।
পরের দিন মোটামুটি ওরা সব গুলো প্রতিযোগীতায় অংশ নিলো। শুধু পায়ে ব্যাথা থাকার কারন অরাভ খেলায় অংশ নিতে পারলো না। সারা দিনের ছয়টা ইভেন্ট এর চারটাতেই ওরা প্রথম। রাতেই ওরা ফিরে যাবে। সবাই যার যার মতো শেষবার ঘুরে বেড়াচ্ছে। অরাভ আর আফরিন আবারো সেই মরা গাছটার ওপর বসে আছে। আফরিন ই এবার কথা বলো শুরু করলো,
> তো অরাভ, ফিউচার প্ল্যান কি?
> পড়াশুনা শেষ করবো, একটা চাকরী করবো। ব্যবসা আমাকে দিয়ে হবেনা। বাবার বিজনেস এর হাল ধরতে পারবো না আমি। আমার ইচ্ছে চাকরী করার।
> ওহ, বিয়ে? কখন বিয়ে করার ইচ্ছে তোমার?
প্রশ্নটা করেই একটু অবাক হলো আফরিন। এই প্রশ্নটা কেন করলো সে?
> আরে বিয়ে, এখনো পর্যন্ত কোন মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারলাম না আর বিয়ে?
> কেন প্রেম না করতে পারলে বিয়ে করা যায়না নাকি?
> তা যায়, আসলে ঐটা বাবা-মার ওপর ছেড়ে দিয়েছি।
>ওহ।
> আর তুমি?
> আমি আর কি? আমার খুব ইচ্ছে জানো, বিয়ের আগে প্রেম করবো। একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো, চাঁদনী রাতে জোছনা দেখবো, একসাথে হাত ধরে নদী তীরে হাঁটবো। একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসবো। এক সাথে থাকবো। তারপর পালিয়ে বিয়ে করবো।
> ওয়াও, তুমি একদম বইয়ের লেখা গুলোর মতো করে কথা বলো।
খিল খিল করে হেসে উঠলো আফরিন।
> না বুদ্ধু, এটাকে রোমান্স বলে। রোমান্টিক কথা বার্তা এগুলো।
জবাবে অরাভ মাথা চুলকাতে লাগলো। দেখে হা হা করতে হাসতে লাগলো আফরিন।
ওরা রওনা হয়ে গেলো। লঞ্চে অরাভ আফরিন একসাথে ডেকে বসে জোছনা দেখছে। আফরিন প্রশ্ন করলো,
> জোছনাটা অনেক সুন্দর তাইনা অরাভ?
> হুম, আসলে চাঁদের তো নিজস্ব কোন আলো নেই, তুমি জানো। সূর্যের আলোর কারনে জোছনার সৃষ্টি।
> অরাভ, সেটা আমিও জানি। আমি বৈজ্ঞানিক ব্যাখা চাইনি। আবেগের কথা বলেছি।
> ওহ, আসলে এই জিনিসটা না আমার মাথায় ঢোকে না !
> হয়েছে, আবেগ নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা।
লঞ্চ থেকে নেমে ওরা পাড়ে দাড়িয়ে আছে। ব্যাগ গুলো বাসে উঠানো হয়েছে। সামনে প্রমত্ত জলরাশি। আফরিন একটু ঝুঁকে দেখতে লাগলো। হটাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে লাগলো। অরাভ চট করে ওর হাত ধরে টেনে তুললো। আফরিন কম্পিত গলায় ওকে ধন্যবাদ দিলো। আফরিন এর জুতোতে কাদা লেগেছে। সে সেটা পরিস্কার করছে আর অরাভ ওর সামনে দাড়িয়ে পানি খাচ্ছিলো। হটাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঝম ঝম বৃষ্টি। ওরা দৌড়ে বাসে উঠতে উঠতে অনেকটাই ভিজে গেলো। সিটে বসে পড়লো দুইজন। মিনিট দশেক এর মধ্যে অরাভ হাচ্চি ফেলা শুরু করলো। আফরিন ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো ‘আসলে আমার না অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যায়’। আফরিন মুচকী হেসে ব্যাগ থেকে একটা তোয়ালা বের করে দিলো অরাভ কে। বাসের মধ্যে দুইজন গল্প করতে লাগলো। একসময় অরাভ কথা কথায় জিজ্ঞেস করলো
> আচ্ছা তোমার ঘুম পাচ্ছে না?
> পাচ্ছে তো, কিন্তু বাসের সিট টা কেমন যেন, ঘুমিয়ে শান্তি পাই না।
> তুমি আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।
অরাভ এমন করে বললো যেন একটা ছোট বাচ্চা অন্য একটা বাচ্চাকে তার খেলনা নিয়ে খেলার সুযোগ দিচ্ছে। আফরিন কোন জবাব না দিয়ে অরাভের কাঁধে মাথা রাখলো। হটাৎ করেই আফরিন এর চোখ ভিজে গেলো। ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরতে লাগলো । অরাভ ওর দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। আফরিন কাঁদছে। অরাভ নড়ে উঠতে আফরিন চট করে মাথা তুলে নিয়ে চোখ মুছলো। অরাভের প্রশ্ন
> কাঁদছো কেন?
> না কই?
> দেখ, লুকানোর চেষ্টা করবে না। কেন কাঁদছ?
> আরে নাহ এমনি।
> কচু, মানুষ এমনি কাঁদে না। কেন কাঁদছ?
> আসলে ছোট বেলা থেকেই বলতে গেলে কারো আদর না পেয়ে মানূষ হয়েছি। মা যতোদিন ছিলেন অসুস্থ ছিলেন। বাবার কোনদিন সময় হয়নি মেয়ে কেমন আছে দেখার জন্য। যখন যা লাগতো চাইতেই পেতাম। কিন্তু ভালোবাসা পাইনি। কলেজ এ অনেক বন্ধু আমার, কিন্তু খুব ভালো করেই জানি, বিপদের সময় কাউকেই কাছে পাবো না, কেউ আমার কষ্টটা বুঝবে না। সাথে এটাও জানি আবেগ কি তুমি জানোনা, বোঝনা। তারপরও কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যে আমাকে বোঝে, আমার কষ্ট বোঝে। তোমার কাঁধে মাথা রেখে অনেক শান্তি লাগছিলো। তাই কান্না পেলো।
> আজব মানুষ তোমরা মেয়েরা জানো। সুখেও কাঁদো, দুখেও কাঁদো। তোমাদের কান্নার সাইকোলজি আমি বুঝি না সত্যিই।
এ কথা শুনে হেসে ফেললো আফরিন।
> জানো অরাভ, আজ আমার তিনটা সপ্নই পুরন হয়েছে।
> কেমন?
> নদীর তীরে হাত ধরে হাঁটবো, হেঁটেছি।
> ধুরো, ঐটা তো দূর্ঘটনা !
> হোকনা দূর্ঘটনা, কিন্তু হাত তো ধরেছি। এরপর একসাথে বৃষ্টিতে ভিজলাম। আবার লঞ্চে একসাথে জোছনাও দেখেছি !!!
> খাইছে, কি ক্যালকুলেশন ! একটাও তো মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে নয়।
> আরে নাহ। মজা করলাম।
মুখে মজা করলাম বললেও আফরিন এর চেহারা অন্য কিছু বলছিলো। বাকি রাস্তা কখনো অরাভের কাঁধে মাথা রেখে, কখনো গল্প করে কাটালো ওরা। বাস থেকে নামার সময় কেন যেন আফরিন এর খুব খারাপ লাগতে লাগলো। এই সফর দিয়ে ঈদের ছুটি শুরু হলো। নানা ধরনের ছুটি মিলিয়ে দুই সপ্তাহ পর কলেজ খুলবে। ততোদিন দেখা হবেনা অরাভের সাথে। কেন যেন মনে হচ্ছে অরাভের সাথে এই সফরের স্মৃতি গুলো অনেক কষ্ট দেবে ওকে।
বাস থেকে নেমেই প্রথমে অরাভ আফরিন এর নম্বর নিলো। ঠিকানা নিলো। নিজের নম্বর দিলো। এসব করতে করতে দেখলো দূরে একটা গাড়ি এসে দাড়িয়েছে। অরাভের বাবা পাঠিয়েছেন। অরাভ কে নিতে। অরাভ আফরিন এর দিকে হেসে বললো, ‘যেতে হবে, আবার দেখা হবে আফরিন, ভালো থেকো’। আফরিন জবাবে শুধু হাসলো। কারন ও জানে এখন কথা বলতে গেলে কেঁদে ফেলবে ও।
বাসায় ফিরে অরাভের মায়ের অতি-আদরে অরাভের জীবন ওঠাগত। কি হয়েছে আমার ছেলের, পায়ে কিভাবে কাটলো, কে মেরেছে, থানা, পুলিশ, মেডিকেল এসব নিয়ে মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে বাসায়। অরাভ অনেক কষ্টে সবাইকে শান্ত করলো। নিজের রুমে গিয়ে শার্ট খুলতে গিয়ে হতাৎ আবিস্কার করলো ওর শার্টের বোতামে একটা চুল আটকে আছে। আফরিন এর চুল। সারা দিন চলে গেলো, অরাভের কিছুই ভালো লাগছে না। না ফেসবুক না বই না গেম। মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভূল হয়েছে। ও কিছু একটা মিস করেছে। অরাভের মামা এসেছেন ভাগ্নে ফিরেছে শুনে। কিন্তু ভাগ্নেকে জানালার ধারে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। ভাঙ্গে তার কম্পিউটার আর বই নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন, আজ সে কিনা জানালার ধারে?
> কি মামু, উদাস কেন?
> আরে মামা। কেমন আছ? আসো, বসো।
> আমি তো ভালো আছি, দূলাভাই এর বেটা, তোর কি হইছে? উদাস কেন?
> আরে মামা, ক্যালকুলেশন এ কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে।
> কিসের ক্যালকুলেশন?
কিছু না বলে অরাভ আফরিন এর চুলটা ওর মামার হাতে দিলো। চুলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকলেন মামা। এরপর হটাৎ করেই যেন সব ফকফকা হয়ে গেলো।
> ভাগ্নে, ক্যালকুলেশন এ ভূল হয়নি। জীবনে প্রথমবার সঠিক ক্যালকুলেশন করেছিস !
> মানে?
> আরে হাঁদারাম, তুই প্রেমে পরেছিস !
> বল কি?
> হ রে বেটা ইডিয়েট। এই চুল যার, তার জন্য খারাপ লাগছে?
> হুম
> তাকে বার বার মনে পড়ছে? তার স্মৃতি মনে আসছে? তার সাথে কোন খারাপ বিহাভ করলে সেটার জন্য অনুতাপ হচ্ছে?
> হুম
> আর কি লাগে? মামু আমার প্রেমে পরেছে। যা বেটা, কোন সে মেয়ে, চল আমার সাথে।
> আরে মামা, কি শুরু করলা বলো তো।
> আরে বোকা, এটাই প্রেম। তুমি মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিস।
> এখন?
> এখন কি মানে? যা, ওকে বল তুই ওকে ভালোবাসিস !
> কিভাবে বলবো?
> ইডিয়েট। আমার বোনের মতো হয়েছিস একদম। মাথায় ঘেলু নাই। শোন, বেশিরভাগ মেয়েই ড্রামাটিক্যাল প্রোপোজাল লাইক করে। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখিস। সহজ মনে যদি কিছু বলিস, সেটার চেয়ে ভালো কিছু নাই।
> মামা দুই দিন পর ঈদ। আর এখন আমি যাবো ওকে এই কথা বলতে?
> নাহ ঠিক বলেছিস। এখন যাস না। পরে যাস।
> কবে?
> বিয়ের পর ওর যখন দুটো বাচ্চা হবে তখন, হাঁদারাম !
সকাল থেকে চুপ চাপ বসে আছে আফরিন। আজ ঈদ। বাসায় অনেক মেহমান। সে সব নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই ওর। একগাদা শপিং করেছে। কিন্তু বাসার ড্রেস পরে বসে আছে। অরাভের কথা মনে পড়ছে। ছেলেটা আজব। একবার ও ফোন করেনি ফেরার পর থেকে। আফরিন ও ফোন করেনি রাগ করে। খুব ইচ্ছে করছিলো আজ অরাভের সাথে রিকশায় ঘুরবে। কিন্তু কিসের কি ! অরাভের কোন পাত্তা নেই। কাজের মেয়ে এসে ঘরে ঢুকলো
> আফা, আফনের লগে দেখা করার লাইগ্যা এই ভাইজান আইছে।
আফরিন একটু অবাক হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলো। কে এসেছে আবার?
ড্রয়িং রুমে ঢুকে অবাক। অরাভ এসেছে। সাদা একটা পাঞ্জাবী পড়েছে। গলার কাছে বাদামী সুতোর কাজ করা। একেতো ফর্সা, সাদা পাঞ্জাবী পরে একদম রাজপুত্রের মতো লাগছে ! আফরিন লক্ষ করলো ওর বাবা কোথায়? উনি ছাদে বন্ধুবান্ধবের সাথে সেমাই খেতে ব্যাস্ত। আফরিন কিছু না বলেই সোজা অরাভের হাত ধরে ওকে নিজের রুমে আনলো। রুমের দেওয়ালে একটা বিশাল ছবি। একজন মহিলার। অরাভ দেখেই বুঝলো এটা আফরিন এর মা। চেহারায় অনেক মিল। আফরিন ধরা গলায় বললো, কেমন আছ?
> ভালো ।
> এতোদিন পর আমার কথা মনে পড়লো?
> না, প্রতিদিন মনে পড়ে। কিন্তু আসলে ঈদের চেয়ে ভালো দিন পেলাম না দেখা করার জন্য। মামা বললো এই দিনে দেখা করলে বাসার কেউ কিছু বলবে না।
আফরিন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।
> তারপর?
> তারপর কি?
> কিছু না? আচ্ছা বস তাহলে, সেমাই নিয়ে আসি।
> আরে নাহ। আমি মিষ্টি খাই না !
> ওহ, নুডুলস? চটপটি? ফুচকা? হালিম?
> কিছুই খাবো না। আসলে তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিলো।
> কি?
একটা লাল গোপাল বের করে দিলো অরাভ আফরিনকে। আফরিন অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে।
> ফুল দেবে? কেন?
> ইয়ে মানে, মামা বললো ফুল দিলেই তুমি সব বুঝে যাবে। মনে হচ্ছে মামা ঠিক বলেনাই ।
আফরিন এর ইচ্ছে হলো নিজের কপাল চাপড়ায়। এতো সুন্দর, ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে, সব বোঝে। প্রেম ভালোবাসা বোঝে না।
> কি বুঝবো? কিসের কথা বলেছেন তোমার মামা?
> মানে ইয়ে মানে …………….
> কি ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করছ? কি বলতে চাও?
> মানে আমি যে তোমাকে ভালোবাসি এটা তুমি বুঝে যাবে গোলাপ দিলে।
আফরিন আর কিছু শুনলো না। অরাভের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অরাভ তো অবাক ! এমন করলো কেন?
> আফরিন, তোমার কি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?
> না বুদ্ধু। আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি কারন আই লাভ ইউ ইডিয়েট।
অরাভ মনে মনে ভাবছে আই লাভ ইউ মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু ইডিয়েট তো গালি। দুইটার কম্বিনেশন সে বুঝলো না।
> ইয়ে আফরিন, ইংলিশে আই লাভ ইউ আর ইডিয়েট তো একসাথে যায় না !
> চুপ করো বুদ্ধু কাঁহিকা।
হটাৎ করেই কেন যেন অরাভ সব বুঝতে পারলো। সব বুঝতে পারলো। অস্ফুষ্ট স্বরে বলে উঠলো
> আই লাভ ইউ টু।